কামরুল ইসলাম: ভারতের পশ্চিম উপকূলের গুজরাটের ভাভনগর জেলায় অবস্থিত আলাং শিপব্রেকিং ইয়ার্ড বিশ্বে সবচেয়ে বড় জাহাজভাঙ্গা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রায় ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল জুড়ে সারিবদ্ধভাবে থাকা শত শত ইয়ার্ডে ভাঙা হয় বিশাল সব সমুদ্রগামী জাহাজ। ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়ার পর থেকে আলাং বিশ্ব শিপ রিসাইক্লিং বাজারের নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে কার্যকর হওয়া হংকং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ভারতের আলাংয়ের জন্যও বড় পরিবর্তন বয়ে এনেছে। আন্তর্জাতিক শর্ত পূরণের প্রস্তুতি নেওয়ায় আলাং এখন নতুন এক রূপে আত্মপ্রকাশ করছে।
আলাংয়ের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
আলাংয়ের জাহাজভাঙ্গা শিল্প ভারতের স্টিল খাতের অন্যতম ভিত্তি। এখানে বছরে প্রায় ৪০–৫০ লাখ টন স্ক্র্যাপ স্টিল উৎপন্ন হয়, যা ভারতের অবকাঠামো, নির্মাণ ও ভারী শিল্পে ব্যাপক অবদান রাখে। শুধু তাই নয়, ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, জেনারেটর, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, আসবাবপত্র, এমনকি গৃহস্থালি সামগ্রীও এখানে পুনর্ব্যবহার হয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়।
প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক সরাসরি আলাংয়ে কাজ করেন, আর পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন।
আধুনিকায়নের যাত্রা
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনায় আলাং অনেক আগেই হংকং কনভেনশনের শর্ত পূরণের প্রস্তুতি শুরু করে। ভারতের সরকার ও গুজরাট রাজ্য প্রশাসন যৌথভাবে ইয়ার্ডগুলো আধুনিকায়নে নীতি সহায়তা দিয়েছে।
প্রায় ৯০% ইয়ার্ড ইতিমধ্যেই “Statements of Compliance” (SoC) পেয়েছে, যা হংকং কনভেনশন অনুযায়ী স্বীকৃত।
কনক্রিট ফ্লোর, ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান্ট, অয়েল-স্পিল কন্ট্রোল সিস্টেম এবং বিশেষ হ্যাজার্ডাস ওয়েস্ট স্টোরেজ ইউনিট তৈরি করা হয়েছে।
শ্রমিকদের জন্য মেডিক্যাল সেন্টার, ট্রেনিং স্কুল এবং জরুরি উদ্ধার ইউনিটও চালু হয়েছে।
ফলে আজ আলাং আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছে সবচেয়ে নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য রিসাইক্লিং কেন্দ্রগুলোর একটি হয়ে উঠেছে।
শ্রমিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্য
আলাংয়ের শ্রমিকদের অধিকাংশই উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা অভিবাসী। আগে দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড ও স্বাস্থ্যঝুঁকি এখানে সাধারণ ঘটনা ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রমিক সুরক্ষায় বড় পরিবর্তন এসেছে।
- হেলমেট, সেফটি বেল্ট, মাস্ক ও সুরক্ষা জুতা এখন বাধ্যতামূলক।
- প্রতিটি ইয়ার্ডে প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র রাখা হয়েছে।
- বিপজ্জনক বর্জ্যের সংস্পর্শে আসা শ্রমিকদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করা হয়েছে।
শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, এখনও অনেক কিছু উন্নত করার প্রয়োজন আছে, তবে আগের তুলনায় পরিবেশ অনেক বেশি নিরাপদ।
পরিবেশগত সুরক্ষা
আলাং উপকূলে একসময় সমুদ্রজীববৈচিত্র্যের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছিল। তবে কনভেনশনের প্রভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও তেল-রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এখন প্রায় সব ইয়ার্ডে Hazardous Waste Disposal Facilities রয়েছে। গুজরাট পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড নিয়মিত মনিটরিং করছে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানি শিপিং কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যেই আলাংয়ে জাহাজ পাঠাতে শুরু করেছে, কারণ এখানে এখন আন্তর্জাতিক মান পূরণের নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে। শিপমালিকদের জন্য নিরাপদ ও টেকসই রিসাইক্লিংয়ের নিশ্চয়তা থাকায় আলাংয়ের প্রতি তাদের আস্থা বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হংকং কনভেনশনের কার্যকরের পর আলাং তার আধিপত্য আরও সুসংহত করবে।
চ্যালেঞ্জ
তবে সবকিছু ইতিবাচক নয়।
শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি এখনও কম।
স্থানীয় গ্রামবাসীরা বলছে, পরিবেশ দূষণ পুরোপুরি রোধ করা যায়নি।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আরও উন্নত প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
- ভবিষ্যৎ চিত্র
- আলাং এখন এক রূপান্তরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে আগে পরিবেশ দূষণ ও শ্রমিক মৃত্যুর জন্য সমালোচিত হতো, এখন তা ধীরে ধীরে বিশ্বে সবচেয়ে টেকসই জাহাজভাঙ্গা কেন্দ্রগুলোর একটিতে পরিণত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আলাংয়ের অভিজ্ঞতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো—বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য একটি শিক্ষা হয়ে দাঁড়াতে পারে।