Home ইতিহাস ও ঐতিহ্য আলীগড় আন্দোলন: উপমহাদেশীয় মুসলিম রেনেসাঁর মহাকাব্য

আলীগড় আন্দোলন: উপমহাদেশীয় মুসলিম রেনেসাঁর মহাকাব্য

স্যার সৈয়দ আহমেদ খান: মুসলিম রেনেসাঁর রূপকার

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতের মুসলিম সমাজ যখন চরম হতাশা, দারিদ্র্য আর ব্রিটিশদের আক্রোশে জর্জরিত, ঠিক তখনই এক আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হন স্যার সৈয়দ আহমেদ খান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, বরং আধুনিক শিক্ষা এবং বিজ্ঞানমনস্কতাই পারে এই জাতিকে অন্ধকারের গহ্বর থেকে টেনে তুলতে। তার এই নিরলস প্রচেষ্টাই ইতিহাসে ‘আলীগড় আন্দোলন’ নামে পরিচিত।

১৮১৭ সালে দিল্লির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া সৈয়দ আহমেদ খান কর্মজীবনে ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা। সিপাহি বিদ্রোহের ভয়াবহতা তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন এবং অনুভব করেছিলেন যে, আধুনিক বিশ্বের সাথে পাল্লা দিতে হলে মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্য কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সামগ্রিক সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কার। এর প্রধান লক্ষ্যগুলো ছিল:

ইংরেজি শিক্ষা প্রচার: মুসলমানদের ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বের করে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলা।

ব্রিটিশদের সাথে সুসম্পর্ক: মুসলিমদের ওপর থেকে ব্রিটিশ সন্দেহের কালো মেঘ সরিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা।

সামাজিক সংস্কার: বহুবিবাহ, অশিক্ষা এবং কুসংস্কার দূর করে একটি প্রগতিশীল সমাজ গঠন।

আলীগড় আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ (MAO College), যা পরবর্তীতে ১৯২০ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (AMU)-এ রূপান্তরিত হয়। এটি ছিল তৎকালীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার এক অনন্য মিলনস্থল। এখান থেকেই জন্ম নিয়েছিল পরবর্তী প্রজন্মের অসংখ্য মুসলিম নেতা, বুদ্ধিজীবী ও গবেষক।

স্যার সৈয়দ আহমেদ খান প্রথম দিকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বললেও পরবর্তীকালে মুসলিমদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক স্বার্থের ওপর জোর দেন। তিনি মনে করতেন, ব্রিটিশরা চলে গেলে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শাসনে মুসলমানরা অবহেলিত হতে পারে। তার এই রাজনৈতিক দর্শনই পরবর্তীকালে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ (Two-Nation Theory) এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সৃষ্টির তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

আলীগড় আন্দোলন কেবল উত্তর ভারতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাসহ গোটা ভারতবর্ষে।

মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটে।

নারীদের শিক্ষার গুরুত্ব অনুভূত হয়।

উর্দু সাহিত্যের বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ শুরু হয়।


একনজরে আলীগড় আন্দোলন

বৈশিষ্ট্য বিবরণ
প্রাণপুরুষ স্যার সৈয়দ আহমেদ খান
কেন্দ্রবিন্দু আলীগড়, উত্তরপ্রদেশ, ভারত
প্রধান প্রতিষ্ঠান এম.এ.ও কলেজ (প্রতিষ্ঠা: ১৮৭৫)
পত্রিকা ‘তহজিব-উল-আখলাক’ (সামাজিক সংস্কারের জন্য)
মূলমন্ত্র শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রগতি

স্যার সৈয়দ আহমেদ খান ও তার আলীগড় আন্দোলন ছিল মুসলিম সমাজের জন্য এক ‘নবজাগরণ’ বা রেনেসাঁ। তিনি মুসলিমদের এক হাতে কোরআন আর অন্য হাতে আধুনিক বিজ্ঞান তুলে দিতে চেয়েছিলেন। তার সমালোচকরা অনেক থাকলেও, আজ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সমাজের আধুনিকায়নের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার প্রধান স্থপতি ছিলেন তিনিই।