আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দেখতে না পেলেও সেই ক্ষত রয়ে যায় হৃদয়ের গভীরে। তেমনই অদৃশ্য কিন্তু তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছেন সিঙ্গাপুরের দুই তরুণ-তরুণী ক্লারিসা ফুং ও মারিয়াস ম্যাডসেন। একা নন, তাদের মতো অসংখ্য মানুষ যাঁরা শরীরের মারাত্মক আঘাত থেকে বেঁচে ফিরলেও, মানসিকভাবে আর কখনও আগের মতো হতে পারেননি।
২০২২ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ক্লারিসার স্কুলজীবনের এক প্রিয় বন্ধু। সেই সময় মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ক্লারিসা মারাত্মকভাবে আহত হন। মাথায় আঘাত, স্মৃতি হারানো, হাড় ভাঙা ও অঙ্গের ক্ষতি—সব মিলিয়ে দীর্ঘ সময় ছিলেন কোমায়।
দুই বছর পরও এই ২৫ বছর বয়সী তরুণী এখনো কিছুটা স্মৃতিভ্রষ্টতা ও মনঃসংযোগের সমস্যায় ভোগেন। এমনকি দুর্ঘটনার দিন কী ঘটেছিল, কার সঙ্গে ছিলেন—এসব কিছুই মনে নেই। নিজের ছবিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, “এটা কে?”
অন্যদিকে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে ভবন থেকে পড়ে কোমরের নিচের অংশে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন মারিয়াস ম্যাডসেন। কখনো তায়কোয়ান্দোর ব্ল্যাকবেল্ট ছিলেন, এখন হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন।
তবে শারীরিক ব্যথার চেয়েও বড় যন্ত্রণা ছিল মনের একাকীত্ব। আত্মীয়-বন্ধুরা পাশে থাকলেও কেউ বুঝতে পারছিলেন না তাঁদের মানসিক ক্ষত। এই বোধ থেকেই জন্ম নেয় সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর ট্রমা-র উদ্যোগে ‘ট্রমা সারভাইভার সাপোর্ট গ্রুপ’—দেশের প্রথম শারীরিক আঘাতপ্রাপ্তদের জন্য সহায়তা কেন্দ্র, যেখানে যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে পরস্পরকে শক্তি জোগান সদস্যরা।
এখন এই দলে ১৮ থেকে ৬৩ বছর বয়সী ১৪ জন সদস্য রয়েছেন। বছরে দু’বার তারা একত্রে বসেন; ভবিষ্যতে সদস্য সংখ্যা ও সেশনের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শারীরিক আঘাতের পাশাপাশি PTSD, উদ্বেগ, নিদ্রাহীনতা ও বিষণ্নতার মতো সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে ভোগাতে পারে। অনেকে দুর্ঘটনার দৃশ্য বা আওয়াজ এড়িয়ে চলেন, ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নে ভোগেন, কিংবা রেগে যান—সবই মানসিক আঘাতের বহিঃপ্রকাশ।
মারিয়াস প্রথমে সংশয়ী ছিলেন, অচেনা লোকজনের সঙ্গে এমন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করা কতটা ফলপ্রসূ হবে—তা নিয়ে। পরে বুঝেছেন, একই যন্ত্রণায় আক্রান্ত মানুষের পাশে থেকে কথা বলা মানেই নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া।
আবার ক্লারিসা এখন ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা ফিরে পেতে কাজ করছেন। SG Enable নামক একটি সংস্থার সহায়তায় কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। যদিও এখনো আগের মতো দ্রুত কাজ করতে পারেন না, তবুও তিনি হার মানেননি।
“যারা এমন ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমি বলতে চাই—তোমরা একা নও। চেষ্টা করো, একটু একটু করে এগোবে, ঠিকই পারবে,” বললেন ক্লারিসা।
মারিয়াস আবার ফিরে গেছেন খেলাধুলায়। হুইলচেয়ার ব্যবহার করেও অংশ নিচ্ছেন প্যারা-তায়কোয়ান্দো ও তীরন্দাজিতে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় জিতেছেন দুটি স্বর্ণপদক। এখন তিনি চান আন্তর্জাতিক প্যারা গেমসে সিঙ্গাপুরকে প্রতিনিধিত্ব করতে।
তাঁর ভাষায়, “সহায়তা চাওয়ার মানে দুর্বলতা নয়। বরং এগিয়ে যাওয়ার জন্য সাহস লাগে। এখন আমি নতুন এক উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচছি—অন্যদের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে।”