আমিরুল মোমেনিন, ঢাকা: বাংলাদেশে গ্রামীণ সড়ক মানেই ছিল ইটের সোলিং বা খোয়া-বালু দিয়ে গঠিত একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল কাঠামো। বর্ষা এলেই সড়কের গর্তে পানি জমত, গাড়ি চলাচলে সৃষ্টি হতো ঝুঁকি, আর রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হতো সরকারি বিপুল অর্থ। কিন্তু অবকাঠামো নির্মাণে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ধীরে ধীরে এ প্রেক্ষাপট বদলে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টেকসই বিকল্প হিসাবে গুরুত্ব পাচ্ছে ইউনিব্লক প্রযুক্তি, যা গ্রামে-গঞ্জে সড়ক নির্মাণে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে।
ইউনিব্লক আসলে একটি ইন্টারলকিং কংক্রিট ব্লক সিস্টেম, যেখানে ব্লকগুলো পরস্পরের সঙ্গে শক্তভাবে জুড়ে একটি সমতল ও স্থিতিশীল পেভমেন্ট তৈরি করে। বহু দেশে এটি অ্যাপ্রোচ রোড, ফুটপাত, পার্কিং এলাকা ও হালকা-মাঝারি যান চলাচলের রাস্তা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এ প্রযুক্তির পথিকৃৎ। পরে ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও এই ইন্টারলকিং সড়ক জনপ্রিয় হয়।
বাংলাদেশে ইউনিব্লক প্রযুক্তির প্রবেশ ঘটে মূলত ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কিছু পরীক্ষামূলক প্রকল্পের মাধ্যমে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে প্রথমে ছোট আকারে ইউনিয়ন ও উপজেলার সংযোগ সড়কে ব্লক বসানোর কাজ শুরু হয়। তখন এটি ‘ইন্টারলকিং ব্লক রোড’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে রাজউক, সিটি করপোরেশন, হাউজিং প্রকল্প এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পথচারী সড়ক ও লাইট ভেহিকল রোডে ইউনিব্লকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউনিব্লকের প্রধান সুবিধা হলো এর দীর্ঘস্থায়িত্ব এবং সহজ রক্ষণাবেক্ষণ। ব্লক ক্ষতিগ্রস্ত হলে পুরো রাস্তা কাটতে হয় না, কেবল ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি তুলে নতুন ব্লক বসিয়ে মেরামত করা যায়। ফলে সড়কের আয়ু হয় বেশি এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় তুলনামূলক কম। পানি নিষ্কাশনে সুবিধা থাকায় বর্ষায় সড়কের ক্ষতির মাত্রাও কমে যায়। গ্রামীণ ও শহরতলির ভুমিধসপ্রবণ এলাকায় এটি অতিরিক্ত স্থিতিশীলতা দেয়।
ইউনিব্লক প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধব হিসেবেও প্রশংসিত। ব্লক তৈরিতে উচ্চমানের কম্প্রেশন ও কিউরিং প্রক্রিয়া ব্যবহার হওয়ায় এগুলোর শক্তিমত্তা বেশি হয়, এবং ভাঙাচোরা ইটের বিকল্প হিসেবে কংক্রিট ব্লকের ব্যবহার পরিবেশের ওপর চাপ কমায়। একই সঙ্গে এই ব্লক পুনর্ব্যবহারযোগ্য, অর্থাৎ রাস্তা ভেঙে ফেললেও ব্লকগুলো অন্যত্র ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে উপজেলা ও ইউনিয়নপর্যায়ের সড়ক প্রকল্পে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। কারণ, স্থানীয়ভাবে ব্লক উৎপাদনের ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে, যা ব্যয় কমিয়েছে। বিশেষত যেসব এলাকায় মাটির গুণগত মান দুর্বল বা প্রচলিত সড়ক দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, সেখানে ইউনিব্লক একটি কার্যকর সমাধান হয়ে উঠছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, যেকোনো প্রযুক্তি টেকসই হতে হলে মান নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। অনেক জায়গায় নিম্নমানের ব্লক ব্যবহার করায় রাস্তাগুলো দ্রুত নষ্ট হওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এজন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (LGED) এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও কঠোর নজরদারি চালানোর পরামর্শ দেন তাঁরা।
এরপরও ইউনিব্লক প্রযুক্তিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গ্রামীণ অবকাঠামোর একটি সম্ভাবনাময় দিক হিসেবে দেখা হচ্ছে। সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে এটি কেবল সড়ক নির্মাণের অভিজ্ঞতাকেই পাল্টাবে না, বরং গ্রামীণ যোগাযোগে একটি নতুন মানদণ্ড তৈরি করবে।








