ইয়াঙ্গুন সফর: এক সাংবাদিকের চোখে (পর্ব–২)
কামরুল ইসলাম: ইয়াঙ্গুন সফরের দ্বিতীয় দিনটি ছিল আমার পেশাগত কৌতূহলের দিন। চট্টগ্রাম থেকে যেহেতু আমার মূল দায়িত্ব ছিল শিপিং খাত নিয়ে লেখা, তাই স্বাভাবিকভাবেই টানটা ছিল বন্দরের দিকে। সফরসঙ্গী সাংবাদিক বন্ধুটি হেলালউদ্দিন চৌধুরী তখন শহরের ঐতিহ্য ঘুরে দেখতে ব্যস্ত, আর আমি আগ্রহভরে রওনা দিলাম ইয়াঙ্গুন বন্দর এলাকায়।
শহরের কেন্দ্র থেকে বন্দর পর্যন্ত যাত্রা প্রায় ত্রিশ মিনিটের। রাস্তার দু’পাশে দেখা যায় পুরনো ব্রিটিশ আমলের গুদামঘর, মরচে পড়া লোহার দরজা, কোথাও কোথাও নতুন করে গড়ে ওঠা কন্টেইনার ইয়ার্ড। ইয়াঙ্গুন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল—চট্টগ্রামের কর্ণফুলী পাড়েরই আরেক সংস্করণ।
বন্দরের প্রবেশপথে তখনও আন্তর্জাতিক জাহাজের আনাগোনা তুলনামূলক কম, কিন্তু স্থানীয় ট্রেডারদের ব্যস্ততা বেশ চোখে পড়ার মতো।
একজন স্থানীয় এজেন্টের সহায়তায় ঢুকেছিলাম Myanmar Port Authority-র ভেতরে। অফিসের দেয়ালে ঝোলানো ছিল বিশ্বনকশা ও ইয়াঙ্গুন বন্দরের রুটম্যাপ। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল চট্টগ্রাম ও ইয়াঙ্গুনের সমুদ্রপথা। দূরত্ব মাত্র ৩৪০ নটিক্যাল মাইল, অর্থাৎ প্রায় একদিনের নৌযাত্রা। অথচ রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেই ঘনিষ্ঠ সমুদ্র সংযোগ বছরের পর বছর প্রায় অচল হয়ে আছে।
বন্দরের কর্মকর্তারা জানালেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই চট্টগ্রাম ও ইয়াঙ্গুন ছিল ব্রিটিশ আমলের দুই গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। একসময় বর্মা থেকে কাঠ, তেলবীজ ও সামুদ্রিক পণ্য যেত চট্টগ্রাম হয়ে কলকাতায়, আর সেখান থেকে কাপড়, মসলা ও হস্তশিল্প পৌঁছাত ইয়াঙ্গুনে।
অনেকে বলতেন—“চট্টগ্রাম ছিল রেঙ্গুনের জানালা, আর রেঙ্গুন ছিল চট্টগ্রামের আয়না।”
একটি শিপিং কোম্পানি অফিসে গিয়ে কথা বলেছিলাম এক বাঙালি বংশোদ্ভূত কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি বললেন, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ আমলেই এখানে এসেছিলেন। তখন আকিয়াব ও ইয়াঙ্গুনের বন্দর দিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা প্রচুর কাঠ, মাছ, চাল আমদানি করতেন। এখন সেই ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে।”
তিনি মৃদু হেসে যোগ করলেন, “তবু সম্পর্ক মরে না, শুধু রূপ বদলায়।”
ইয়াঙ্গুন বন্দরে ঘুরতে ঘুরতে লক্ষ্য করলাম, ছোট ছোট ট্রলার ও কার্গো নৌকা সারিবদ্ধভাবে পণ্য খালাস করছে। স্থানীয় শ্রমিকদের দক্ষতা প্রশংসনীয়—কেউ দড়ি বেঁধে কার্গো তুলছেন, কেউ আবার নদীর কিনারে নৌকার ভারসাম্য ঠিক রাখছেন। সেই দৃশ্য মনে করিয়ে দিল চট্টগ্রামের সাদারঘাট বা পতেঙ্গার জেটির সকালবেলার চিত্র।
পরের দিন দেখা করেছিলাম কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে, যারা এখনও চট্টগ্রাম-মিয়ানমার বাণিজ্য সচল রাখতে চেষ্টা করছেন। তাঁরা বললেন, আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য সীমিত হলেও “অনানুষ্ঠানিক লেনদেন” বা ছোট নৌযানে সীমান্ত বাণিজ্য এখনো চলছে। টেকনাফ-সিত্তে-আকিয়াব রুটে নৌকার যাত্রা আজও বহু মানুষের জীবিকা।
আমার আগ্রহ ছিল, যদি কোনো চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইয়াঙ্গুনে অফিস রাখে। জানতে পারলাম, আশির দশকে কিছু বাঙালি ব্যবসায়ী ‘Burma-Bangla Trading Co.’ নামে কাজ করতেন। তারা মূলত চট্টগ্রাম ও ইয়াঙ্গুনের মধ্যে পাট, শুকনো মাছ ও সামুদ্রিক খাদ্য রপ্তানি-বাণিজ্য করতেন। এখন তাদের উত্তরসূরিরা হোটেল বা ক্ষুদ্র ব্যবসায় জড়িত।
বন্দর থেকে ফেরার পথে নদীর ওপারে সূর্য ডুবছিল। সেই আলোকছটায় ইয়াঙ্গুনের বন্দর যেন ইতিহাসের কোনো নিঃশব্দ স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছিল, সময় বদলে গেছে, কিন্তু সমুদ্রের ঢেউ এখনো হয়তো জানে, একদিন এই জলপথ দিয়েই চট্টগ্রাম থেকে রেঙ্গুনে যেত ব্যবসা, যেত বন্ধুত্ব, যেত সংস্কৃতির বিনিময়।
সেদিন হোটেলে ফিরে হেলালউদ্দিনকে বলেছিলাম,
“তুমি ইতিহাস খুঁজছো প্যাগোডায়, আমি খুঁজে পেলাম বন্দরে।”
ও হেসে বলেছিল, “তুমি তো খুঁজে ফেলেছো চট্টগ্রামের ছায়া ইয়াঙ্গুনের বুকেই।”










