Home চট্টগ্রাম ইসলামী ব্যাংক টাওয়ার ঘেরাও, এস আলমবিরোধী মানববন্ধন

ইসলামী ব্যাংক টাওয়ার ঘেরাও, এস আলমবিরোধী মানববন্ধন

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে এস আলম গ্রুপের মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অপসারণের দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার (৬ অক্টোবর ২০২৫) সকালে রাজধানীর দিলকুশায় ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারের সামনে ইসলামী ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারস ফোরামের উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। একই সময়ে সারাদেশে ইসলামী ব্যাংকের সব শাখার সামনে ইসলামী ব্যাংক গ্রাহক ফোরাম, ইসলামী ব্যাংক প্রাক্তন ব্যাংকার পরিষদ, সচেতন ব্যবসায়ী ফোরাম ও বৈষম্যবিরোধী চাকরিপ্রত্যাশী পরিষদের উদ্যোগে একযোগে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়।

সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ করেন, এস আলম গ্রুপ রাষ্ট্রীয় প্রভাব ব্যবহার করে ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখল করে নেয়। সে সময় বৈধ মালিক ও বিদেশি শেয়ারহোল্ডারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বিতাড়ন করা হয়। বক্তাদের দাবি, দখলের পর থেকে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই পটিয়া ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের হাজার হাজার লোক নিয়োগ দেয়া হয়, যা ব্যাংকের প্রশাসনিক কাঠামো ও দক্ষতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

বক্তারা বলেন, “এস আলম ব্যাংক দখল করে এটিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। তিনি তার নিজ এলাকার লোকজনকে চাকরি দিয়ে ব্যাংকের সুনাম, শৃঙ্খলা ও গ্রাহক আস্থা ধ্বংস করেছেন।” তাদের দাবি, অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্তদের মাধ্যমে ব্যাংকের তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে, যা ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

বক্তারা জানান, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন পদে ৭,২২৪ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৪,৫০০ জনের বেশি শুধুমাত্র চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা। এভাবে সারা দেশের মেধাবী প্রার্থীদের বঞ্চিত করে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন।

সমাবেশে বলা হয়, এসব অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ কর্মচারীর পেছনে প্রতিবছর প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের মুনাফা হ্রাস পেয়েছে এবং গ্রাহকসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।

ইসলামী ব্যাংক সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ)-এর মাধ্যমে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষার আয়োজন করে। ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ৫,৩৮৫ জনকে আহ্বান জানানো হলেও মাত্র ৪১৪ জন অংশ নেয়। বাকী ৪,৯৭১ জন পরীক্ষায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ ঘটনার পর পরীক্ষায় অনুপস্থিতদের মধ্যে প্রায় ৪০০ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছে এবং বাকিদের অফিস সংযুক্ত (ওএসডি) করেছে। তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনা হয় এবং অপারেশনাল কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়।

সমাবেশে প্রাক্তন কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নিম্নপদস্থ কর্মী বক্তব্য দিয়ে জানান, কীভাবে তাদের বাধ্য করা হয়েছিল পদত্যাগ করতে। ড্রাইভার নূরুল হক বলেন, “আমাকে বলা হয়েছিল— পদত্যাগপত্র না দিলে সার্ভিস বেনিফিট পাব না। বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয়। আমার মতো আরও অনেককেই একইভাবে চাপ দেয়া হয়।”

তার বক্তব্য অনুযায়ী, শুধু ড্রাইভার নয়, মেসেঞ্জার, ক্লিনার, এমনকি অনেক কর্মকর্তা ও নির্বাহীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অবসরে পাঠানো হয়। তাদের দাবি, এস আলমের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিন নিজ এলাকার লোক নিয়োগের জন্য এই চাপ প্রয়োগ করতেন।

একজন নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “ভুয়া বিনিয়োগ ফাইল অনুমোদন না করায় কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে হাতকড়া পরিয়ে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছিল।”

বক্তারা বলেন, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের অপসারণকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলা যাবে না। বরং প্রকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে যখন ৬৩ জেলার প্রার্থীদের বঞ্চিত করে কেবল একটি উপজেলার প্রার্থীদের গোপনে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তারা দাবি করেন, এসব নিয়োগের মাধ্যমে এস আলম ব্যাংকের নীতি, নিয়ম ও কর্পোরেট সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছেন। বক্তাদের মতে, “ইসলামী ব্যাংক এখন একদল মাফিয়ার কবলে পড়েছে। আমরা শেয়ারহোল্ডার ও গ্রাহকরা যেকোন মূল্যে এ ব্যাংককে রক্ষা করব।”

বক্তারা ঘোষণা দেন, যদি বৃহস্পতিবারের মধ্যে অবৈধ নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অপসারণ না করা হয়, তবে তারা দেশব্যাপী বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করবেন। এ আন্দোলনে ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক, শেয়ারহোল্ডার, প্রাক্তন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী সমাজকে যুক্ত করার প্রস্তুতি চলছে বলে জানানো হয়।

মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয় ইসলামী ব্যাংক শেয়ারহোল্ডারস ফোরাম, ইসলামী ব্যাংক গ্রাহক ফোরাম, ইসলামী ব্যাংক প্রাক্তন ব্যাংকার পরিষদ, সচেতন ব্যবসায়ী ফোরাম, বৈষম্যবিরোধী চাকরিপ্রত্যাশী পরিষদ, সচেতন পেশাজীবী গ্রুপ, ইসলামী ব্যাংক সিবিএ ও সচেতন ব্যাংকার সমাজ।

২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বড় ধরনের পরিবর্তনের পর থেকে ব্যাংকটির মালিকানা ও নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তখন থেকেই ব্যাংকের শেয়ার কাঠামো, ঋণ বিতরণ, কর্মকর্তা নিয়োগ ও পরিচালনা পর্ষদে এস আলম গ্রুপের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও একাধিকবার ইসলামী ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অনিয়ম নিয়ে তদন্ত চালিয়েছে, যদিও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়নি।

বক্তারা বলেন, ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন দেশের ব্যাংকিং খাতে একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু এস আলমের নিয়ন্ত্রণের পর ব্যাংকটি ক্রমে অনিয়ম, দুর্নীতি ও আঞ্চলিক স্বার্থের কবলে পড়ে। তাদের দাবি, দ্রুত অবৈধ নিয়োগ বাতিল ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নতুন নিয়োগ না দিলে ব্যাংকটির ভাবমূর্তি ও আর্থিক স্থিতি আরও বিপন্ন হবে।