ধারাবাহিক প্রতিবেদন: উত্তরের জীবনরেখা – কুড়িগ্রামকে জানুন কাছ থেক
পর্ব ৩:
নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রাম মানেই নদী, আর নদী মানেই চর। এই চরাঞ্চলেই গড়ে উঠেছে হাজারো মানুষের বসতি, সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার গল্প। চর মানে শুধু ভূখণ্ড নয়, বরং প্রতিনিয়ত টিকে থাকার এক নিরব যুদ্ধ। যারা নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে চরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের জীবন যেন প্রতিদিনই শুরু হয় নতুন করে—শূন্য থেকে।
চরের মানচিত্রে মানুষ নেই, আছে বেঁচে থাকার ছায়া
কুড়িগ্রামের চরগুলো মূলত ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার মাঝখানে জেগে ওঠা বালু ও কাঁদামাটির দ্বীপ। এই চরগুলোর বেশিরভাগই প্রশাসনিক মানচিত্রে নেই, অনেক জায়গায় আজও কাগজে-কলমে সুনির্দিষ্ট মালিকানাও নেই।
এখানে নেই সড়ক, নেই বিদ্যুৎ, নেই স্থায়ী স্কুল বা হাসপাতাল। চরবাসীদের জন্য সরকারি সেবা পৌঁছায় না বা পৌঁছায় না সময়মতো।
ফুলবাড়ী উপজেলার জামিরচরের বাসিন্দা রাশেদা খাতুন বলেন, “আমরা ভোট দিই, কিন্তু সরকারি লোক দেখি শুধু বন্যার সময় বা ভোটের সময়। বাকি সময় কেউ জিজ্ঞেসও করে না।”
জীবনযাত্রা: বালির ওপর গড়ে ওঠা সংসার
চরের মানুষ কৃষিকাজ, জেলে পেশা ও দিনমজুরিতেই জীবন চালায়। বর্ষায় নদী তাদের চারদিকে ঘিরে রাখে, শুকনো মৌসুমে মাইল পেরিয়ে বাজারে যেতে হয় হাঁটতে বা গরুর গাড়িতে।
বন্যায় চর তলিয়ে গেলে অনেকে বাঁধের ওপর ছোট ছোট ঘর তুলে অস্থায়ীভাবে থাকে। আবার অনেকেই চরের ভেতরে কুড়েঘর তৈরি করে বছরের পর বছর জীবন চালিয়ে নেয়।
একটি ঘর, একটি নৌকা, কিছু গরু বা ছাগল—এই নিয়েই তাদের জীবনের সম্পদ। তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা—সবকিছুই নদীর জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভরশীল।
শিক্ষা ও স্বপ্নের সংকট
চরের শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গেলেও মাধ্যমিকে টিকে থাকতে পারে না। অনেক চরেই নেই কোনো স্কুল, যেখানে আছে, সেখানে শিক্ষক থাকেন না। চরাঞ্চলের মেয়েরা অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়, অনেক সময় সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে।
বাল্যবিবাহ, মাতৃত্বজনিত জটিলতা ও অপুষ্টি—এসব হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্য বাস্তবতা। তবুও কিছু মানুষ লড়ছেন। নিজের মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর জন্য মা খালেদা বেগম ধান কাটার কাজ করেন আশপাশের গ্রামে।
তিনি বলেন, “মেয়েকে চর ছেড়ে স্কুলে দিতে পারলে হয়তো তার জীবন আমাদের মতো হবে না।”
প্রশাসনের দৃষ্টি শুধু দুর্যোগে
বন্যা এলে ট্রলার ভর্তি ত্রাণ আসে। সাংবাদিক আসে, ক্যামেরা আসে, আশ্বাস আসে। কিন্তু বন্যা সরে গেলে চরবাসী যেন আবার অদৃশ্য হয়ে যায়।
চরভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা, পরিবহন-যোগাযোগের স্থায়ী ব্যবস্থাপনা বা স্কুল-স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ আজও অনুপস্থিত।
কুড়িগ্রামের চরগুলোতে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা মাঝে মাঝে নৌকা-স্কুল চালান, কেউ কেউ মোবাইল ক্লিনিক বসান। কিন্তু তাতে হাজার মানুষের সমস্যা সাময়িকভাবেই মেটানো যায়।
সম্ভাবনাও আছে, যদি পরিকল্পনা থাকে
চরে উৎপাদিত ফসল ভুট্টা, পেঁয়াজ, মরিচ, সূর্যমুখী দারুণ সম্ভাবনা রাখে। মাছচাষ, গবাদিপশু পালন, চরভিত্তিক পর্যটনও গড়ে উঠতে পারে সঠিক নীতিতে। প্রয়োজন চরকে ‘প্রান্ত’ না ভেবে ‘মূল’ ভাবার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা।
📢 আপনি কি কখনও কুড়িগ্রামের কোনো চর দেখেছেন? চরবাসীর জীবনের এই বাস্তব চিত্র আপনাকে ছুঁয়ে গেলে শেয়ার করুন প্রতিবেদনটি, জানিয়ে দিন অন্যদেরও।
👍 লাইক দিয়ে উৎসাহ দিন উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি নয়ন দাসকে, যিনি চর থেকে চর ঘুরে এই কাহিনি সংগ্রহ করেছেন।
🗨️ চরের মানুষের প্রতি আপনার অনুভব, মন্তব্য বা স্মৃতি—নিচে লিখে জানান, পরবর্তী পর্বে আমরা কিছু পাঠকের অভিমতও তুলে ধরতে চাই।
📌 পরবর্তী পর্বে আসছে—‘বঞ্চনার জেলা: উন্নয়ন সূচকের নিচের সারিতে কুড়িগ্রাম’। চোখ রাখুন বিজনেসটুডে২৪.কম-এ।