ধারাবাহিক প্রতিবেদন: উত্তরের জীবনরেখা – কুড়িগ্রামকে জানুন কাছ থেকে
পর্ব ৪:
নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রাম যেন উন্নয়ন মানচিত্রে রাষ্ট্রের এক উপেক্ষিত কোণ। আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো প্রায় সব সূচকেই কুড়িগ্রাম দীর্ঘদিন ধরে দেশের নিচের সারিতে। প্রতি বছর পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি আসে, উন্নয়নের স্লোগান বাজে, কিন্তু বাস্তবে জেলার প্রান্তিক জনপদের জীবনে তার স্পর্শ মেলে না।
আয় ও দারিদ্র্যের চিত্র ভয়াবহ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, কুড়িগ্রাম দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলাগুলোর একটি। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ দিনে এক থেকে দেড়শ টাকার দিনমজুরিতে সংসার চালায়। কৃষিকাজ, ভাসমান শ্রমিক বা সীমান্ত ব্যবসা- এইসবই তাদের আয়ের উৎস।
জেলার অন্তত ৫০ শতাংশের বেশি পরিবার মৌসুমি দারিদ্র্যের শিকার। বর্ষা মৌসুমে চরের জমি ডুবে গেলে বা নদীভাঙন হলে কাজ থাকে না, খাবার জোটে না। অনেক পরিবার ৩-৪ মাস খেয়ে-না খেয়ে থাকে। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামীণ এলাকাগুলোতে এই চিত্র আরও ভয়াবহ।
যোগাযোগ ব্যবস্থার অবস্থা দুর্বল
সড়ক অবকাঠামো এখনও অত্যন্ত দুর্বল। চরাঞ্চলের সঙ্গে উপজেলা সদরের সংযোগ এখনো নৌকাভিত্তিক। সেতু কিংবা পাকা রাস্তা বহু জায়গায় অনুপস্থিত। বর্ষাকালে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাজারে কৃষিপণ্য পৌঁছায় না, রোগী হাসপাতালে পৌঁছায় না, শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না।
কুড়িগ্রাম সদর থেকে রৌমারী কিংবা রাজীবপুরে যেতে এখনো তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগে, যাত্রাপথের অনেক অংশই কাঁচা এবং ভাঙাচোরা।
স্বাস্থ্যসেবা নেই বললেই চলে
জেলায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও চিকিৎসক থাকেন না, ওষুধ থাকে না। বিশেষ করে চরে বসবাসকারী মানুষদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রায় অনুপস্থিত। একজন মা প্রসব ব্যথা নিয়ে নৌকা করে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে হাসপাতালে যান—এটাই এখানে স্বাভাবিক দৃশ্য।
চিকিৎসার অভাবে প্রতি বছর ডায়রিয়া, আমাশয়, নিউমোনিয়া ও সাপের কামড়ে বহু মৃত্যু ঘটে। স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ থাকলেও অনেকে চরে যান না নিরাপত্তার অভাবে বা যাতায়াত অসুবিধায়।
শিক্ষা মানে শুধু প্রাথমিক স্তরে যাওয়া
কুড়িগ্রামে শিক্ষার হার জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক কম। অনেক চর ও নদীপাড়ের এলাকায় এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। যেখানে স্কুল আছে, সেখানে শিক্ষক অনুপস্থিত, পাঠ্যবই বিলম্বে আসে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়তে চাইলে শিশুদের কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হয়। ফলে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সেই অনেক শিশু শিক্ষা ছেড়ে দেয় এবং কাজে জড়িয়ে পড়ে।
শিল্পায়ন নেই, কর্মসংস্থান নেই
কুড়িগ্রামে কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই। সীমান্তে কিছু হাটবাজার থাকলেও তাতে স্থানীয়দের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয় না। সরকারি প্রকল্প আসে, কিন্তু তা চরের দরিদ্র পরিবারগুলোকে ছুঁয়ে যায় না।
কেন এই বঞ্চনা?
বিশেষজ্ঞদের মতে, কুড়িগ্রাম বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হয় না। আবার রাজধানী ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দৃষ্টিতে এটি ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং স্থায়ী পুনর্বাসন পরিকল্পনার অনুপস্থিতিও কুড়িগ্রামের পিছিয়ে থাকার বড় কারণ।
তবে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো—কুড়িগ্রামের মানুষ এই বঞ্চনাকে মেনে নেওয়ার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এটিই সবচেয়ে বড় হুমকি।
📢 একটি জেলার অবহেলিত বাস্তবতা আমাদের সবাইকে ভাবায়। কুড়িগ্রামের এই সত্যচিত্র যদি আপনার হৃদয় স্পর্শ করে, তাহলে প্রতিবেদনটি শেয়ার করুন—যেন আরও মানুষ জানে এই জেলার বঞ্চনার গল্প।
👍 লাইক দিয়ে জানান, আপনি কুড়িগ্রামের পাশে আছেন। নয়ন দাসের এই ধারাবাহিক প্রচেষ্টাকে উৎসাহ দিতে কমেন্ট করতে পারেন আপনার মতামতও।
🗨️ আপনার জেলা বা অভিজ্ঞতার সঙ্গে কুড়িগ্রামের মিল আছে কি? নিচে লিখে জানান, আমরা শুনতে চাই প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠ।
📌 পরবর্তী পর্বে থাকছে—‘কৃষির সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা: ধান-পাট-ভুট্টার মাঠে হারিয়ে যাওয়া আশা’। বিজনেসটুডে২৪.কম-এ চোখ রাখুন।
(পরবর্তী পর্ব: কৃষির সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা – ধান-পাট-ভুট্টার মাঠে হারিয়ে যাওয়া আশা)