ধারাবাহিক প্রতিবেদন: উত্তরের জীবনরেখা – কুড়িগ্রামকে জানুন কাছ থেকে
পর্ব ৫:
নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রাম একসময় পরিচিত ছিল ধানের গোলা, পাটের ভান্ডার আর চরভিত্তিক ভুট্টা উৎপাদনের সম্ভাবনায়। অথচ আজ সেই কৃষিনির্ভর জেলার কৃষক বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছেন ধার, দুশ্চিন্তা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। চাষাবাদ এখন আর শুধু জমিতে বীজ ফেলা নয়—এটা এক অনিশ্চয়তার নাম, যেখানে ফলন আসলেও লাভ আসে না।
ধান উৎপাদনের ভেতরে জমে থাকা হতাশা
কুড়িগ্রামের প্রধান ফসল হলো ধান। বছরে তিন মৌসুমে ধান চাষ হয়—আমন, বোরো ও আউশ। কিন্তু সমস্যার শুরু বীজ, সার ও সেচ খরচেই।
প্রত্যন্ত চরে অথবা নদীপারের জমিতে চাষ করতে গিয়ে কৃষকদের ব্যয় বেড়ে যায় দ্বিগুণ, অথচ উৎপাদিত ধানের দাম পড়ে যায় মৌসুম শেষে।
স্থানীয় কৃষক আজিজুল হক বলেন, “পাঁচ বিঘা জমিতে ধান চাষ করে এবার লোকসান খেয়েছি। ধান বিক্রি করে খরচই উঠে না, মুনাফা তো দূরের কথা।”
পাট: যে ছিল স্বর্ণফসল, এখন হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনা
এক সময় কুড়িগ্রাম ছিল পাটের রাজ্য। ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার তীরে পাট পচানো, শুকানো ও বাজারজাত করাই ছিল মানুষের মৌসুমী আয়ের অন্যতম উৎস।
কিন্তু এখন পাটচাষ কমে গেছে নাটকীয়ভাবে। কারণ সঠিক দাম না পাওয়া, কৃষিযন্ত্রের অভাব, পাট শিল্পে বাজার সংকট ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব।
একজন প্রবীণ চাষি আবদুল কাদের বলেন, “আমাদের সময় পাটের টাকা দিয়েই বিয়ে-শাদী হতো। এখন তো বাজারেই বিক্রি হয় না।”
ভুট্টা ও চরভিত্তিক শাকসবজি চাষে নতুন সম্ভাবনা
কিছু চরাঞ্চলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভুট্টা, পেঁয়াজ, সূর্যমুখী ও সবজি চাষে সাফল্য মিলেছে। বিশেষ করে নাগেশ্বরী ও উলিপুরের চরগুলোতে ভুট্টা ও বাদাম চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে।
কিন্তু বড় সমস্যা হলো—পণ্য বাজারজাতকরণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। খরচ বেশি, রাস্তাঘাট নেই, আর বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে শ্রমিক, ট্রান্সপোর্ট খরচেই লাভ চলে যায়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যা কৃষির বড় শত্রু
প্রতি বছর বন্যা এলে হাজার হাজার একর জমির ফসল ডুবে যায়। কখনও বীজ বপনের সময় নদীর পানি উঠে আসে, কখনও ঠিক ধান কাটার মৌসুমেই হঠাৎ ঝড়।
কৃষকের নিজের কোনো নিরাপত্তা নেই। বীমা, ক্ষতিপূরণ বা সরকারি সহযোগিতার উদ্যোগ নামে মাত্র। ফলে পরের মৌসুমে জমি চাষ করাই হয়ে ওঠে কঠিন।
কৃষিনির্ভর জেলার কৃষকেরা আজও পিছিয়ে কেন?
কুড়িগ্রামের কৃষকেরা এখনও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সেবার বাইরে। আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, কৃষি প্রশিক্ষণ নেই, বাজারদর ও আবহাওয়ার আগাম বার্তা নেই।
জেলাটি এত বড় কৃষিনির্ভর হলেও এখানে নেই কোনো কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, কৃষক সমবায় কিংবা আধুনিক গুদাম। ফলে লাভজনক কৃষির স্বপ্ন বারবার ভেঙে পড়ে।
সম্ভাবনা আছে, দরকার সঠিক পরিকল্পনা
চরের জমি অত্যন্ত উর্বর। এখানকার কৃষক পরিশ্রমী। শুধু দরকার সরকারি বিনিয়োগ, চরভিত্তিক কৃষি পরিকল্পনা, বাজারসংযোগ, ন্যায্য দাম আর কৃষকের পাশে দাঁড়ানো।
এভাবে কুড়িগ্রাম হতে পারে ‘প্রান্তিক কৃষির আদর্শ মডেল’।
📢 এই প্রতিবেদন ভালো লাগলে লাইক দিন, শেয়ার করুন, আর কুড়িগ্রামের কৃষকদের নিয়ে আপনার মতামত জানান কমেন্টে।
আগামী পর্বে থাকছে চরাঞ্চলের সাহসী নারীদের গল্প—মিস করবেন না!