ধারাবাহিক প্রতিবেদন: উত্তরের জীবনরেখা – কুড়িগ্রামকে জানুন কাছ থেকে
পর্ব ৬:
নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম:ধরলার চর, ব্রহ্মপুত্রের কিনারা, তিস্তায় ঘেরা জনপদ এইসব জায়গার নারীরা একসময় শুধুই গৃহস্থালি সামলাতেন, ঘর সামলানোই ছিল তাদের নিয়তি। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন সেই নারীরা সেলাই মেশিন হাতে নিচ্ছেন, গরু-পালনের খামারে নামছেন, হস্তশিল্প তৈরি করছেন, এমনকি মোবাইল নিয়ে বাজার খোঁজ করছেন।
শিক্ষা-চাকরি নয়, নিজের হাতের কাজ দিয়েই বদলে দিচ্ছেন নিজেদের জীবন।
মাটি আর কাঁদা থেকে উঠে দাঁড়ানো নারীরা
চরের ঘরগুলোতে এখন সন্ধ্যায় আলো জ্বলে সৌরবিদ্যুতে, আর সেখানে একেকজন নারী বসে কাঁথা সেলাই করেন, কেউ লেপ-তোষক বানান, কেউ আবার গাভি দোহেন।
রাজীবপুর উপজেলার চর বড়াইবাড়ীর সাহেরা বেগম বললেন, “একসময় স্বামীর হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এখন আমি নিজেই আয় করি—বাড়ির খরচ, মেয়ের পড়াশোনা, সব চালাতে পারি।”
এই আয় আসে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রকল্প, এনজিও সহায়তা এবং নিজস্ব প্রচেষ্টা থেকে। কেউ শিখেছেন প্রশিক্ষণে, কেউ দেখেছেন পাশের বাড়ির দুলাভাইয়ের কাজ।
সংগ্রামের শুরুটা ছিল ভয় আর অনিশ্চয়তায়
চরের নারীরা একসময় ঘর থেকে বের হতেন না। সমাজের চোখ, নিরাপত্তাহীনতা আর অর্থনৈতিক দারিদ্র্য তাদের আটকে রেখেছিল।
কিন্তু বন্যা আর ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে বাস্তবতা। ঘর ভাঙলে, রোজগারের লোক কাজ হারালে—নারীরা নেমে পড়েছেন মাঠে। প্রথমে গোপনে, পরে সাহস নিয়ে।
কুড়িগ্রাম সদরের এক নারী বললেন, “আমার স্বামী নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে একদিন আর ফেরেনি। তখন তিন সন্তান নিয়ে আমিই সব। প্রথমে শুরু করি কলা বেচা, এখন গরু কিনে পালন করি। আমি এখন আয় করি, কেউ আর দয়া করে না।”
স্বাবলম্বীতার গল্প এখন শুধু শহরে নয়, চরেও
উলিপুর, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী এই সব উপজেলায় নারীরা এখন স্বনির্ভর দল গড়ে তুলেছেন। ৫-৭ জন মিলে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে গড়ে তুলছেন হাঁস-মুরগির খামার, শাকসবজির বাগান, দুধ বিক্রির উদ্যোগ।
বাজারে গিয়ে নিজের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করছেন, অনেকেই মোবাইলে অর্ডার নিচ্ছেন।
উলিপুরের নারগিস বেগম এখন ৮টি গরুর খামারের মালিক। তিনি বলেন, “এটা শুধু ব্যবসা না, আত্মসম্মানের লড়াই। কেউ এখন আমাকে ‘বেচারী’ বলে না।”
বাধা আছে, কিন্তু সাহস বড় শক্তি
নারীদের সামনে এখনো অনেক বাধা। জমির মালিকানা নেই, পরিবারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কম, অনেকে এখনও ঘরছাড়া হতে ভয় পান।
তবুও, এই সাহসী নারীরা চুপ থাকেন না। স্থানীয় এনজিও ও সরকারি কিছু প্রকল্প তাদের পাশে থাকলে তারা এগিয়ে যেতে চান আরও দূর।
সম্ভাবনার পথ খোলা, দরকার সমর্থন
নারীদের তৈরি হস্তশিল্প, খাদ্যপণ্য, দুধ ও শাকসবজি বাজারজাত করার ব্যবস্থা থাকলে তারা অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন। চরভিত্তিক নারী উদ্যোগের জন্য প্রশিক্ষণ, বিনিয়োগ ও ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা জরুরি।
(পরবর্তী পর্ব: সীমান্তবাসীর জীবন – কাঁটাতারের ছায়ায় অসম্ভব প্রতিদিন)
📢 এই প্রতিবেদন ভালো লাগলে লাইক দিন, শেয়ার করুন, এবং চরাঞ্চলের নারীদের এই সাহসী গল্পকে পৌঁছে দিন আরও অনেকের কাছে।
আপনার মন্তব্য আমাদের আগ্রহী করে পরবর্তী পর্বে!