ধারাবাহিক প্রতিবেদন: উত্তরের জীবনরেখা – কুড়িগ্রামকে জানুন কাছ থেকে
পর্ব ৭:
নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জেলা, যার প্রায় ২৭৭ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে ভারতীয় রাজ্য আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগ রয়েছে। এই সীমান্ত এলাকা স্পর্শ করে জেলার চারটি উপজেলা-ভুরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ী, রৌমারী ও রাজীবপুর।
দৃশ্যপটে কাঁটাতারের বেড়া, চেকপোস্ট আর বিএসএফ-এর টহল থাকলেও বাস্তবে এ জনপদে প্রতিদিন গড়ে ওঠে জীবনের এক অসম লড়াই-বেঁচে থাকার, নিরাপত্তা চাওয়ার, আর অসহায়ত্বের বিরুদ্ধে।
স্বাধীনতাহীন নিরাপত্তার ছায়া
সীমান্তের গ্রামগুলোতে দিন শুরু হয় গরু-মহিষ মাঠে তোলা দিয়ে, কিন্তু দিন গড়াতেই তা উদ্বেগে পরিণত হয়—”ফিরবে তো?”
প্রতি সন্ধ্যায় মা-বোনেরা খোঁজ নেন, কেউ বিএসএফের টহলে ধরা পড়ল কি না, কেউ নদী পার হয়ে ফেরত এলো কি না।
বুড়িমারী সীমান্তের একটি গ্রামে স্থানীয় কৃষক সাহেব আলী জানান, “খেত আমাদের, নদী আমাদের, কিন্তু কাঁটাতার পার হলে আমরাই অপরাধী হয়ে যাই।”
রাত ৮টার পর অধিকাংশ সীমান্ত গ্রামে চলাফেরা নিষেধ। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে কড়া টহল বাড়ে, ঘোষণা আসে “বর্ডার সিল”।
চোরাচালান: জীবনযাত্রার এক অপ্রত্যাশিত উপায়
সীমান্তের মানুষ চোরাপথ বেছে নেয় অনেকটা নিরুপায় হয়ে। ফসলের ক্ষতি, বন্যা, জমি নদীগর্ভে চলে যাওয়া এসবই তাদের ঠেলে দেয় ঝুঁকিপূর্ণ পথে।
গরু, শাড়ি, চিনি, এমনকি নিষিদ্ধ ওষুধ ট্যাবলেটও সবই এই সীমান্ত পথে চলে আসে। ভুরুঙ্গামারীর এক যুবক বলেন,
“কেউ যেতে চায় না, কিন্তু তিন মাস কাজ না থাকলে পেট চালাতে নামতেই হয়। এটা বেছে নেওয়ার নয়, এটা ঠেকা পড়ে যাওয়া।”
অনেক সময় গ্রামের কিশোরদেরও টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয় দুইশত-তিনশত টাকার লোভে রাতের অন্ধকারে পেছনের বীথি ধরে গরু টানা হয় সীমান্তঘেঁষা নদী পার করে।
বিএসএফ-জনতা সম্পর্ক: ভয় আর অনিশ্চয়তা
কুড়িগ্রামের সীমান্তে গত কয়েক বছরে গুলিবিদ্ধ হয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের অধিকাংশই গরু খোঁজ করতে গিয়ে কিংবা কাজের সন্ধানে সীমান্ত ঘেঁষে চলতে গিয়ে।
বিএসএফ প্রায়ই সন্দেহে গুলি চালায়। তাদের দৃষ্টিতে, যে কেউ চোরাকারবারি।
চর রাজীবপুরের এক বৃদ্ধা নারী জানান, “আমার ছেলে মাছ ধরতে গেছিল, ফিরে এল কাপড়ে মোড়ানো লাশ হয়ে। এখনো বোঝে না সরকার—আমরা কেউ চোর না।”
অনেক সময় মৃতদেহ ফেরত আনতে হয় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে, লাশ পড়ে থাকে দিনের পর দিন সীমান্তের ওপারে।
শিশুরাও বন্দিত্বে বড় হয়
এই সব সীমান্তবর্তী গ্রামে জন্ম নেওয়া শিশুরা বড় হয় এক অদৃশ্য ভয় নিয়ে “সীমান্তে যাস না, ওখানে গুলি হয়।”
তারা মাঠে খেলতে পারে না, কখনো স্কুলে যাওয়া বন্ধ থাকে, কারণ কাঁটাতারের পাশে গুলির শব্দ চলেছে।
অনেক গ্রামে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, আর শহরের স্কুলে যেতে হলেও দিনের অনেকটা সময় সীমান্ত পার হতে হয়, যা মা-বাবার আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিকল্প পথ নেই?
সরকারিভাবে কিছু প্রকল্প রয়েছে সীমান্তে গরুর খামার, হাঁস-মুরগি পালনের উদ্যোগ, ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম। কিন্তু তা সীমিত, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং দীর্ঘসূত্রতায় বাঁধা।
নতুন প্রজন্ম কর্মসংস্থান না পেয়ে, বিকল্প না পেয়ে আবার সেই পুরোনো চক্রে ফেরে চোরাপথে আয়, তারপর ধরা পড়া, তারপর হয় গুলি, না হয় কারাগার।
পরিত্রাণের পথ কী?
- সীমান্তবাসীদের জীবন শুধুই টহল ও কাঁটাতারে সীমাবদ্ধ নয়, তারা সম্মান চায়, নিরাপদ ভবিষ্যৎ চায়, সন্তানের জন্য একটি বিকল্প চায়।
প্রয়োজন— - শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন
- ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ
- স্থানীয় নিরাপত্তাবাহিনীর মানবিক প্রশিক্ষণ
- দুই দেশের স্থানীয় স্তরের সম্পর্ক উন্নয়ন
- একজন সীমান্তবাসী বললেন, “আমরা দেশের শেষ প্রান্তে থাকি ঠিক, কিন্তু আমাদের জীবনেরও তো একটা দাম আছে।”
- 📢 এই প্রতিবেদন যদি আপনার হৃদয়ে নাড়া দেয়, তাহলে শেয়ার করুন—সীমান্তবাসীর এই নিঃশব্দ সংগ্রাম আরও অনেকের কাছে পৌঁছুক। লাইক দিয়ে উৎসাহ দিন নয়ন দাসকে, আর আপনার মতামত জানিয়ে দিন নিচের মন্তব্যে-আপনি কী ভাবছেন এই জনপদের ভবিষ্যৎ নিয়ে?
- 📌 পরবর্তী পর্বে থাকছে: ‘সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্য: কুড়িগ্রামের গান, পালা ও মেলা’। চোখ রাখুন বিজনেসটুডে২৪.কম-এ।










