ধারাবাহিক প্রতিবেদন: উত্তরের জীবনরেখা – কুড়িগ্রামকে জানুন কাছ থেকে
পর্ব ৮
নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে কুড়িগ্রাম এক গভীর ও নিরব কিন্তু ঐশ্বর্যময় প্রদেশ। ভাষা, লোকসংগীত, পালা, মেলা ও সাহিত্যকর্মের এক উর্বর ভূমি এই কুড়িগ্রাম। এখানে শব্দেরা শুধু কাগজে নয়, জীবনের প্রতিটি স্তরে কথা বলে। কথা বলে ভাওয়াইয়ার সুরে, পালার ছন্দে, মেলার আনন্দে, কিংবা এক নিঃশব্দ প্রতীক্ষার বর্ণনায়।
কুড়িগ্রামের সাহিত্যিক উত্তরাধিকার
কুড়িগ্রামের সাহিত্যিক পরিচয়ে এক অনস্বীকার্য নাম বিধান চন্দ্র রায়। তাঁর কবিতা ও ছোটগল্পে কুড়িগ্রামের কৃষিজীবন, নদী, ক্ষুধা, সংগ্রাম ও মাটির টান প্রতিফলিত হয়েছে। স্থানীয় পাঠাগারগুলোতে এখনো তাঁর লেখা খুঁজে ফেরে কিশোর সাহিত্যপ্রেমীরা। অন্যদিকে হায়াৎ মামুদ—বাংলাদেশের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাহিত্য-সমালোচক—এই জেলারই সন্তান। তাঁর কলমে বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্যের গভীর বুনট স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তাঁরা শুধু লেখেননি, এ অঞ্চলের সাহিত্যকে ধারণ করার পথও করে দিয়েছেন। কুড়িগ্রামের বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সাহিত্য পাঠচক্র, দেয়ালপত্রিকা ও স্থানীয় সাহিত্যসভাগুলোর জন্ম তাঁদের অনুপ্রেরণাতেই।
ভাওয়াইয়া: কুড়িগ্রামের হৃদয়ের গান
ভাওয়াইয়া কুড়িগ্রামের প্রাণ। সরু রাস্তা ধরে গরুর গাড়ি চলার মতো করে বয়ে চলে এই গান—অন্তরের আকুতি, প্রেমের যন্ত্রণা, হারানোর বিষাদে মিশে থাকে এই সুরে।
বিশেষ করে চিলমারী, রৌমারী, উলিপুর অঞ্চলে কৃষক ও গরুর গাড়িয়ালদের মুখে মুখে আজও ভাওয়াইয়া বেঁচে আছে। স্থানীয় গায়ক-গায়িকারা মুখে মুখে শিখে নেয়, আবার নিজস্ব ঢঙে গেয়ে যান। গান গুলোতে তানপুরা নেই, কিন্তু আছে প্রগাঢ় ব্যথা। মেলাযাত্রায় কিংবা হারমোনিয়াম-বাঁশির আসরে বাজে “অপর চিনে না চেনা…ও কইর্যা কয় জ্বালায়”।
পালা গান ও নাট্যচর্চা
পালা গান কুড়িগ্রামের আরেক অনন্য সাংস্কৃতিক দিক। লোকপ্রিয় পালাগুলোর মধ্যে “নবাব সিরাজউদ্দৌলা”, “রূপবান”, “বেহুলা-লখিন্দর” এখনো অনেক এলাকায় গ্রামীণ নাট্যরূপে মঞ্চস্থ হয়। মাঠে খোলা আকাশের নিচে লণ্ঠনের আলোয় শুরু হয় এই পালাগান, চলে গভীর রাত অবধি।
এই পালাগান শুধু বিনোদন নয়, তা হয়ে উঠেছে ইতিহাস শিক্ষারও মাধ্যম। স্কুল পড়ুয়া শিশুদের থেকে শুরু করে গ্রামের প্রবীণ পর্যন্ত এই পালাগানে পান আত্মিক প্রশান্তি।
মেলা: লোকজ সংস্কৃতির প্রাণ
কুড়িগ্রামে বছরের বিভিন্ন সময়ে বসে নানা রকম মেলা। চৈত্র সংক্রান্তি, মহররম, বাংলা নববর্ষ কিংবা অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে গ্রামজুড়ে জেগে ওঠে উৎসবের আমেজ। বড় মেলাগুলোর মধ্যে উলিপুরের চৈত্রমেলা, ভূরুঙ্গামারীর ঐতিহ্যবাহী বারুণী মেলা, এবং নাগেশ্বরীর লোকমেলা এখনো লোকজ সংস্কৃতির চেতনা বহন করছে।
এই মেলাগুলো শুধু কেনাবেচার জায়গা নয়, বরং গল্প বলা, গান গাওয়া, খেলাধুলা, পুতুলনাচ, সাপ খেলা আর হাজারো মুখের এক সম্মিলন।
সংস্কৃতির পথচলা অব্যাহত
কুড়িগ্রামের তরুণরা এখনো তাদের পূর্বপুরুষের সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করে। সাহিত্য পরিষদ, ভাওয়াইয়া চর্চাকেন্দ্র, নাট্যগোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তৎপর রয়েছে। চিলমারী থেকে নাগেশ্বরী—সর্বত্রই সংস্কৃতির এই স্পন্দন টিকে আছে মানুষের মনে, জীবনযাপনে।