Home Third Lead উমামার পদত্যাগ, দীর্ঘ পোস্টে ছাত্র আন্দোলনের ক্ষয়িষ্ণুতা উন্মোচন

উমামার পদত্যাগ, দীর্ঘ পোস্টে ছাত্র আন্দোলনের ক্ষয়িষ্ণুতা উন্মোচন

উমামা ফাতেমা

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম মুখপাত্র ও পরিচিত সংগঠক উমামা ফাতেমা সংগঠনটির সব কার্যক্রম থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। শনিবার (২৮ জুন) সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।

পোস্টে উমামা লিখেছেন, “দীর্ঘ সময় ধরে যুক্ত থাকলেও আজ আমি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সকল কার্যক্রম থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। কোনো ব্যক্তিগত সুবিধা বা বিরোধ নয়, আদর্শিক ও সাংগঠনিকভাবে এই প্লাটফর্মটি আমাকে আর আশ্বস্ত করতে পারছে না।”

উমামা ফাতেমার ২৮ জুনের ফেসবুক পোস্টটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র রাজনীতির একটি গভীর সংকট, ভাঙন এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি—যা শুধু একটি সংগঠনের নয়, বরং গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অসুস্থতা ও দুর্বলতাকেই নগ্নভাবে তুলে ধরেছে। এখানে কয়েকটি বিশ্লেষণধর্মী দিক তুলে ধরা হলো:

১. দায়বদ্ধতা থেকে যাত্রা, হতাশা দিয়ে সমাপ্তি

উমামা তাঁর পোস্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এনসিপি (National Citizens’ Party) গঠনের পরে ‘জুলাই অভ্যুত্থান’-এর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার দায়বোধ থেকেই তিনি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এ সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। এটি ছিল রাজনৈতিক আদর্শ নয়, বরং একটি মানবিক ও নৈতিক প্রেরণা। কিন্তু এই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই তিনি ক্রমশঃ অসহায় ও প্রতারিত বোধ করেন।

২. আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কৌশলের প্রতিচ্ছবি

পোস্টের মধ্যে “দলীয় লেজুড় ও প্রেসক্রিপশনের বাইরে এই ব্যানারটি স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যত হুমকির মুখে পড়ত”—এই মন্তব্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি থেকে স্পষ্ট হয় যে, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ একটি স্বতন্ত্র ছাত্র প্ল্যাটফর্ম নয় বরং এর পেছনে একটি রাজনৈতিক দলের (এনসিপি) ছায়া সক্রিয় ছিল, যা একে ব্যবহার করতে চেয়েছে একটি নিয়ন্ত্রিত হাতিয়ার হিসেবে।

৩. ব্যক্তিগত বিরোধ নয়, কাঠামোগত রাজনৈতিক নোংরামি

তিনি যে নানামুখী চাপ, character assassination, smear campaign ও নিষ্ক্রিয়তা মোকাবিলা করেছেন তা তাঁর বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে। “এই সো কল্ড সহযোদ্ধারা মানুষকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করে”—এই বাক্যটি শুধু হতাশা নয়, রাজনৈতিক ব্যবস্থার এক নিষ্ঠুর ব্যর্থতাও।

৪. ভেতর থেকে পচন ধরার অভিযোগ

উমামা অভিযোগ করেছেন যে, “সুবিধাবাদীরা পোকার মতো প্ল্যাটফর্মকে খেয়ে ফেলেছে”। এটি কোনো ব্যক্তির অভিযোগ নয়, বরং সংগঠনের শাখা কমিটি গঠনের সময় অনিয়ম, মিথ্যাচার এবং প্রভাবশালী মহলের ইচ্ছানুযায়ী নেতৃত্ব বণ্টনের পেছনের বাস্তবতাকে ইঙ্গিত করে।

৫. সম্মানহানির অভিজ্ঞতা ও মানসিক ভাঙন

তিনি জানিয়েছেন, মার্চ-এপ্রিল মাসে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। যারা তার মুখোমুখি হয়ে কথা বলতেন, রাতের অন্ধকারে হেয়ার রোডে গিয়ে পদ-পদবীর জন্য ‘বার্গেইনিং’ করতেন—এই অংশ ছাত্র রাজনীতির ভণ্ডামি ও মুখোশের আড়ালের নিষ্ঠুর বাস্তবতা স্পষ্ট করে।

৬. নেতৃত্বের স্বৈরতান্ত্রিক রূপ

কাউন্সিল ও ভোটের প্রসঙ্গে উমামা এক কঠিন অভিযোগ করেছেন—সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি, ভোটার ছিল নিয়ন্ত্রিত, কিছু অংশীদারই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি যিনি নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন না, তিনিও কাউন্সিল মেম্বার হয়ে যান—যা রাজনৈতিক প্রহসনের চূড়ান্ত নিদর্শন।

৭. ভবিষ্যৎ প্রত্যাহার ও নৈতিক অবস্থান

তিনি কাউন্সিলে প্রদত্ত ভোটও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, যা শুধু প্রতীকী নয় বরং রাজনৈতিকভাবে তাঁর অবস্থানেরও ঘোষণা। “আমি রুহের ভেতর থেকে বদদোয়া দিচ্ছি এই মোনাফেকদের”—এই অভিব্যক্তি শুধু আঘাতপ্রাপ্ত নয়, একটি আদর্শিক বিশ্বাসভঙ্গের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া।

৮. আশার রেখা ও পরামর্শ

সব হতাশার মাঝেও তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অনুরোধ রেখেছেন—“পড়ার টেবিলে মনোযোগ দিন, কাজে মনোযোগ দিন।” নিজেও নতুনভাবে গুছিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন, যা তাঁর ভেঙে পড়া নয় বরং আত্মমর্যাদার এক অনুপম উদাহরণ।

উমামা ফাতেমার পোস্টটি বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের এক গভীর সংকটকাল ও দ্বন্দ্বময় অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক বাস্তবতার দলিল। এটি শুধুই একটি ব্যক্তি বা সংগঠন ত্যাগের গল্প নয়—বরং এটি একটি রাজনৈতিক আদর্শ, বিশ্বাস, এবং যুব শক্তিকে নিয়ন্ত্রণের এক ভয়ানক কৌশলের বিরুদ্ধে একটি সাহসী প্রত্যাখ্যান।

এই পোস্ট ভবিষ্যতে যদি কোন প্রজন্মের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস লেখা হয়, তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।