রামেশ ভট্টরায়, কাঠমান্ডু: নেপালের তিলোরাকোট, যা প্রাচীন কপিলাবস্তু রাজ্যের হৃদয়ভূমি এবং যেখানে সিদ্ধার্থ গৌতমের বাল্যকাল কেটেছে বলে বিশ্বাস করা হয়, তার অসামান্য ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এই স্থানটিকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও সংরক্ষণের কাজ চলছে। কিন্তু এই মহৎ উদ্যোগের এক নির্মম মানবিক মূল্য দিতে হচ্ছে পার্শ্ববর্তী শিবগড় গ্রামের বাসিন্দাদের, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ভূমিতে বসবাস করে আসছেন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের নামে তাদের আবাসস্থল কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, ভাঙছে শত বছরের সামাজিক বন্ধন, আর অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে জীবন-জীবিকা।
১৮৯৯ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক স্কেচেও শিবগড়ের অস্তিত্ব ছিল, যা এর দীর্ঘদিনের ইতিহাস প্রমাণ করে। ২০১৩ সাল থেকে জাপান-ফান্ডস-ইন-ট্রাস্টের সহায়তায় শুরু হওয়া খনন কাজ শিবগড়ের চারপাশে মঠ, স্তূপ, পুকুর এবং শিল্প এলাকার ধ্বংসাবশেষ উন্মোচন করেছে। কাঠমান্ডুর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জানায়, তাদের লক্ষ্য হলো বিদ্যমান ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ এবং পর্যটন সুবিধা তৈরি করা।
তবে এই “উন্নয়ন” শিবগড়বাসীর জন্য বেদনাময়। সরকার ২০১৫ সালের শুরু থেকে ধাপে ধাপে জমি অধিগ্রহণ শুরু করে। যদিও গত বছর আনুষ্ঠানিক নোটিশ জারি করা হয়েছিল, বাসিন্দারা বহু বছর ধরেই অনানুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক ছিলেন। এর আগে বেশিরভাগ গ্রাম খালি করা হয়েছে; এখন আরও এক দফা উচ্ছেদ আসন্ন। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, এবং ২০২৫ সালের শেষের দিকে শিবগড় গ্রামটি সম্পূর্ণ বিলীন হওয়ার পথে।
রাজকুমার যাদব, শিবগড়ের একজন সমাজকর্মী ও ট্যুর গাইড, তার পাঁচ প্রজন্মের পরিবার এখন উচ্ছেদের মুখে। তাদের নতুন বাড়িটি অসম্পূর্ণ, আর সরকারি ক্ষতিপূরণ পুনর্গঠন খরচের তুলনায় অপ্রতুল। অভিযোগ রয়েছে, প্লটগুলোর মূল্য কমিয়ে ধরা হয়েছে এবং ক্ষতিপূরণের ওপরও কর আদায় করা হচ্ছে, যার কোনো রসিদ দেওয়া হয়নি। বহু দরিদ্র পরিবার, বিশেষ করে দলিত ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ, ভূমিহীন হয়ে পড়েছে বা ঋণের জালে জড়িয়ে গেছে। অনেকেই নতুন বাড়ি তৈরি করতে হিমশিম খাচ্ছেন, কেউ কেউ সন্তানদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারছেন না।
কর্তৃপক্ষ, যেমন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের রাম বাহাদুর কুনওয়ার, এই স্থানচ্যুতিকে ন্যায্য বলে দাবি করেন, বলেন যে ক্ষতিপূরণ “ন্যায্য” ছিল এবং বাসিন্দাদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়েছিল। তবে স্থানীয়রা বলছেন, তাদের অভাব-অভিযোগ উপেক্ষিত হয়েছে, এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনাগুলো (যেমন তাইওয়ানের Tzu Chi-এর প্রস্তাব) প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
রাজকুমার তার এনজিও ‘লোথাস সূত্র’-এর মাধ্যমে স্থানীয়দের জন্য ট্যুর গাইডিং প্রশিক্ষণ, বৌদ্ধধর্ম সচেতনতা এবং জীবিকাভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন, যাতে শারীরিক বাড়ি না থাকলেও তারা তিলোরাকোটের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারে।
এই ঘটনা একটি বড় প্রশ্নের জন্ম দেয়: প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণের নামে কি জীবন্ত মানব ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে? তিলোরাকোট ও লুম্বিনী যখন বিশ্বজুড়ে বৌদ্ধ ঐতিহ্যের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত, তখন শিবগড়ের মতো গ্রামগুলোর প্রান্তিককরণ এক তিক্ত বাস্তবতা তুলে ধরে, যেখানে “উন্নয়ন” প্রায়শই প্রান্তিক মানুষের জীবন কেড়ে নেয়।
 
            









