শিপিং ডেস্ক:
জিপিএস জ্যামিংয়ের কারণে নেভিগেশন সিস্টেম ভুল পথে নিয়ে যাওয়ার জেরে এমএসসি কনটেইনার জাহাজ ‘অ্যান্টোনিয়া’ লোহিত সাগরের তলদেশে আটকে গেছে। জাহাজটির অবস্থান জেদ্দা উপকূল থেকে প্রায় ১০০ নটিক্যাল মাইল দক্ষিণে। সেই এলাকায় সম্প্রতি বারবার বৈদ্যুতিক বিভ্রাট ও উপগ্রহভিত্তিক ন্যাভিগেশন ব্যর্থতার খবর পাওয়া যাচ্ছিল।
১১ মে ‘অ্যান্টোনিয়া’র গা-ছোঁয়া ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাতে দেখা যায়, একাধিক টাগবোট বা টানার নৌকা সেটিকে টেনে সরানোর চেষ্টা করছে। স্থানীয় সময় সকাল থেকে শুরু হওয়া উদ্ধারপ্রচেষ্টা এখনও পর্যন্ত সফল হয়নি।
সাত হাজার কন্টেইনার ধারণক্ষমতার জাহাজটি মাল্টা থেকে ছেড়ে লোহিত সাগর হয়ে সৌদি আরবের কিং আবদুল্লাহ বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল। মাঝপথে জেদ্দা বন্দরে থেমে আবার যাত্রা শুরু করলেও, হঠাৎ করে জাহাজটির গতিপথ এদিক-ওদিক হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক জাহাজ নজরদারি প্ল্যাটফর্মে দেখা যায়, ‘অ্যান্টোনিয়া’র স্বয়ংক্রিয় চিহ্নিতকরণ ব্যবস্থা (অ্যাডভান্সড আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম বা এআইএস) ‘মাটি স্পর্শ করেছে’ বলে সংকেত দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ লার্স জেনসেন বলেন, “জাহাজটি সম্ভবত জিপিএস বিভ্রাটের কারণে এলিজা শোয়ালস অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। সেখানে জ্যামিংয়ের কারণে জাহাজের অবস্থান-সংক্রান্ত সিগন্যাল ভুলভাল দেখাচ্ছিল। ফলে এটি নাবিকদের ভুল পথে চালিত করেছে।”
ইউকে এমটিও (ইউনাইটেড কিংডম মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনস) গত ৯ মে একটি সতর্কতা জারি করে জানিয়েছিলযে ওই অঞ্চলে জিপিএস ও অন্যান্য ন্যাভিগেশন প্রযুক্তিতে দীর্ঘ সময় ধরে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। একই সঙ্গে সাইবার গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান ‘উইন্ডওয়ার্ড’ও জানায়, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে জ্যামিং ও স্পুফিংয়ের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
জাহাজটি আটকে যাওয়ার ফলে এর তলায় ক্ষতি হতে পারে, এমনকি যদি জ্বালানি ট্যাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তেল ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমএসসি এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
জিপিএস জ্যামিং কী?
জিপিএস জ্যামিং হল একটি ইলেকট্রনিক পদ্ধতি যেটার মাধ্যমে স্যাটেলাইট থেকে আসা জিপিএস সংকেতকে বাধা দিয়ে তা ব্যবহার অনুপযোগী করে তোলা হয়। জাহাজ, বিমান কিংবা অন্য যে কোনো পরিবহনব্যবস্থা যেগুলো জিপিএসের উপর নির্ভর করে, তা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং ভুল পথ বেছে নেয়।
এ ধরনের জ্যামিং সচরাচর সংঘাতপ্রবণ অঞ্চল বা সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বেশি দেখা যায়। কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে চালানো হয়, কখনো প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে।
কীভাবে উদ্ধার করা হয় এ ধরনের জাহাজ?
১. জোয়ার-ভাটার সুবিধা নেওয়া: জোয়ারের সময় পানির স্তর বেড়ে গেলে জাহাজটি সহজে ভাসতে পারে।
২. টাগবোটের সাহায্যে টানা: শক্তিশালী টাগবোট বা টানার নৌকা ব্যবহার করে ধীরে ধীরে জাহাজকে পেছনের দিকে সরানো হয়।
৩. ভার লাঘব করা: জাহাজের কিছু কন্টেইনার বা তেল খালি করে হালকা করে দেওয়া হয় যাতে এটি সহজে সরানো যায়।
৪. ডাইভার ও সোনার স্ক্যান: সমুদ্রতল পরীক্ষা করে দেখা হয় জাহাজের নিচে কী ধরনের মাটি বা বাধা রয়েছে।
৫. নেভিগেশন পুনঃস্থাপন: বিকল্প ন্যাভিগেশন পদ্ধতির মাধ্যমে নিরাপদ রুট তৈরি করে উদ্ধার কার্য পরিচালনা করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে এমএসসি অ্যান্টোনিয়ার দুর্ঘটনা বিশ্ব মেরিটাইম নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। জিপিএস নির্ভরতা যেমন আমাদের আধুনিক নৌচালনায় সহায়তা করে, তেমনি এর দুর্বলতা আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সময় এসেছে বিকল্প নিরাপত্তা প্রযুক্তি ও শক্তিশালী সাইবার প্রতিরোধ গড়ে তোলার।