নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: বাংলার গ্রামীণ জীবনে একসময় কাঠ চেরাইয়ের দৃশ্য ছিল নিত্যদিনের বাস্তবতা। বিশাল আকৃতির কাঠের গুঁড়ি কয়েকজন মানুষ মিলে করাত দিয়ে চিরে ফেলতেন। উপরে নিচে দাঁড়িয়ে দুই জন শ্রমিক একসঙ্গে টেনে-ছাড়তে থাকতেন করাতের দাঁত, আর আশপাশে অন্যরা কাঠের গুঁড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। এই কাজ নিছকই একটি পেশা নয়—এটি ছিল সম্মিলিত শ্রম, সহযোগিতা ও দক্ষতার এক জীবন্ত দলিল।
জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা ঐতিহ্য
কাঠ ছিল গ্রামীণ জীবনের অপরিহার্য উপাদান—ঘরবাড়ি নির্মাণ, নৌকা বানানো, কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি কিংবা আসবাবপত্রের কাজে কাঠ ছাড়া ভাবাই যেত না। তাই কাঠ চেরাই শুধু পেশা নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবেই বিবেচিত হতো। করাত দিয়ে গুঁড়ি চেরাই করার কাজে প্রয়োজন হতো অসাধারণ ধৈর্য, শারীরিক শক্তি ও নিখুঁত সমন্বয়।
সহযোগিতার দৃষ্টান্ত
এই কাজটি একা কারও পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। অন্তত দুই জন থেকে শুরু করে চার-পাঁচজন শ্রমিক মিলেই কাজ সম্পন্ন করতেন। একে অপরের ওপর নির্ভরশীলতা, পারস্পরিক সহযোগিতা আর ছন্দে ছন্দে করাত চালানো ছিল মূল শক্তি। বলা যায়, এটি ছিল গ্রামের সামাজিক বন্ধন ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার এক নিখুঁত প্রকাশ।
প্রযুক্তির আগমনে পরিবর্তন
আধুনিক যুগে করাতকল ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী করাত চালানো শ্রমিকদের ভূমিকা দ্রুত কমে যায়। এখন মুহূর্তের মধ্যে কাঠ চেরাই করা সম্ভব। এতে সময় ও খরচ বাঁচলেও সেই ঐতিহ্যবাহী দৃশ্য, শ্রমের ছন্দ আর মানুষের সম্মিলিত প্রয়াস প্রায় হারিয়ে গেছে।
হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস
আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না, কেমন ছিল সেই দিনগুলো। ধুলো-মাখা মাটিতে দাঁড়িয়ে ঘাম ঝরানো শ্রমিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা শুধু কাঠ চেরাই নয়, ছিল জীবনের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। সেই দৃশ্য হারিয়ে যাওয়ায় আমরা হারাচ্ছি একটি মূল্যবান সাংস্কৃতিক ও শ্রম ঐতিহ্যও।
করাত দিয়ে কাঠ চেরাই কেবল একটি পেশাগত কাজ ছিল না; এটি ছিল গ্রামীণ সমাজের ঐক্য, সহযোগিতা ও কঠোর পরিশ্রমের প্রতীক। আজ আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জীবন সহজ করেছে ঠিকই, তবে গ্রামবাংলার এই শ্রমনির্ভর ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দেয়—মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করলে যেকোনো কঠিন কাজ সহজ হয়ে ওঠে।