Home কলকাতা ভারতে সেনাবাহিনীর মুসলিম মুখপাত্রকে নিয়ে বিজেপি নেতার ঘৃণাত্মক মন্তব্য: দেশে-বিদেশে ক্ষোভ

ভারতে সেনাবাহিনীর মুসলিম মুখপাত্রকে নিয়ে বিজেপি নেতার ঘৃণাত্মক মন্তব্য: দেশে-বিদেশে ক্ষোভ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের বিজেপি সরকারের এক মন্ত্রী সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে ‘সন্ত্রাসীর বোন’ বলে কটাক্ষ করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সোমবার (১২ মে) মধ্যপ্রদেশের মউ শহরে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এমন মন্তব্য করেন রাজ্যের উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রী কুনওয়ার বিজয় শাহ।

‘অপারেশন সিন্দুর’-এ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র হিসেবে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওই অভিযানে ভারত জবাব দিয়েছিল এপ্রিলের ২২ তারিখ কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গি হামলার পর।

কিন্তু এই প্রেক্ষাপটেই বিজয় শাহের বক্তব্যে উঠে আসে বিতর্কিত ও সাম্প্রদায়িক সুর। তিনি বলেন, “তারা হিন্দুদের পোশাক খুলে হত্যা করেছিল, আর মোদিজি তাদের বোনকে পাঠিয়েছিলেন প্রতিশোধ নিতে। আমরা তাদের পোশাক খুলে ফেলতে পারিনি, তাই আমরা তাদের সম্প্রদায়ের একটি মেয়েকে পাঠিয়েছিলাম…।”

এমন মন্তব্যে সেনাবাহিনীর মতো একটি পেশাদার বাহিনীর সদস্যের ধর্মীয় পরিচয়কে টেনে আনার অভিযোগ উঠেছে। শাহ বলেন, “তোমরা আমাদের সম্প্রদায়ের বোনদের বিধবা করেছ, তামাদেই তোমাদের সম্প্রদায়ের একজন বোন তোমাদের পোশাক খুলে ফেলবে। মোদিজি প্রমাণ করেছেন যে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তোমাদের জাতের মেয়েদের পাকিস্তানে পাঠানো যেতে পারে।”

এই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই শুরু হয় তীব্র প্রতিবাদ। সাবেক সেনা কর্মকর্তারা বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী পেশাদার, এবং ধর্ম, জাতি বা লিঙ্গ নয়—যোগ্যতাই সেখানে একমাত্র বিবেচ্য। কর্নেল সোফিয়া কুরেশি দেশের প্রথম নারী অফিসার হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এবং বর্তমানে তিনি সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বিজেপির এই নেতার বক্তব্য সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং একজন নারী অফিসারের প্রতি চরম অবমাননাকর। কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধী দল এর তীব্র নিন্দা করে বলেন, সেনাবাহিনীর সদস্যদের ধর্মীয় পরিচয় তুলে ধরে এভাবে অপমান করা নিছক রাজনীতিক চরমপন্থা।

তারা অবিলম্বে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্ষমা চাওয়া এবং তার অপসারণ দাবি করেছে। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি, তবে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের মন্তব্য সেনাবাহিনী ও জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে মারাত্মক বিভ্রান্তি তৈরি করে।

ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল বিক্রম সিং বলেন, “সেনাবাহিনীতে ধর্ম নয়, পেশাদারিত্ব ও যোগ্যতাই মুখ্য। একজন অফিসারকে তার ধর্মীয় পরিচয়ে তুলে ধরা মারাত্মক অবমাননাকর এবং সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যের পরিপন্থী।”

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ করণ থাপার বলেন, “যে ভাষায় এই মন্তব্য করা হয়েছে, তা জাতীয় নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা। এই মন্তব্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতেই ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে।”

এই মন্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে নজরে এসেছে। The Guardian, Al Jazeera, ও Deutsche Welle-এর মত সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে বলেছে, “এমন মন্তব্য শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ায় না, বরং এটি সেনাবাহিনীর ভেতরে বৈষম্যের বীজ বপন করে। কর্নেল কুরেশির প্রতি এই অবমাননা নারীর মর্যাদাকেও লঙ্ঘন করে।”

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘটনাকে ‘ভারতীয় সামরিক অভিযানে ধর্মীয় রাজনীতির নগ্ন প্রকাশ’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

বিজেপির পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য আসেনি। তবে দলের অন্দরেও এই মন্তব্য নিয়ে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে বলে জানা গেছে। কংগ্রেস নেতা শশী থারুর বলেন, “এই বক্তব্য জাতীয় লজ্জা। সেনাবাহিনীকে ধর্মের খাঁচায় ফেলে মোদির রাজনীতি তার সীমা অতিক্রম করেছে।”

সিপিআই (এম)-এর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, “এই ধরনের মন্তব্য শুধুই ঘৃণা ছড়ানোর ফাঁদ, যার উদ্দেশ্য মুসলিম অফিসারদের দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।”

কর্নেল কুরেশি ভারতের প্রথম মুসলিম নারী অফিসার হিসেবে ২০০৬ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি সেনাবাহিনীর জনসংযোগ পরিদপ্তরের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং সাম্প্রতিক ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর সময় তার ভূমিকা সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে ধর্ম-নিরপেক্ষতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সদস্যকে এভাবে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা করে উপস্থাপন করা শুধুই সেনাবাহিনীর পেশাদার মানহানি নয়, বরং এটি পুরো ভারতীয় সংবিধান ও গণতন্ত্রের ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ করে।