বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: কর্মক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব বা মতবিরোধ এমন একটি বিষয়, যা প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে কমবেশি ঘটে থাকে। তবে বেশিরভাগ সময়ই এটি থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন কর্মী ও কর্তৃপক্ষ উভয়েই। ফলাফল হয় উল্টো, অমীমাংসিত বিরোধ ধীরে ধীরে অফিসের পরিবেশ, কর্মীদের মনোবল ও প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মক্ষেত্রের দ্বন্দ্বকে “অদৃশ্য চাপ” বলা যায়। কারণ এটি হয়তো চিৎকার-চেঁচামেচি বা প্রকাশ্য বিরোধের মাধ্যমে নয়, বরং নিঃশব্দে অফিসের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। এই চাপ কর্মীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে, দলীয় কাজ ব্যাহত করে এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি ডেকে আনে।
ভুল বোঝাবুঝি থেকে মনস্তাত্ত্বিক চাপ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, অফিসে দ্বন্দ্বের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসে যোগাযোগের ঘাটতি, দায়িত্ববোধের অস্পষ্টতা, ব্যক্তিত্বের পার্থক্য, পক্ষপাতমূলক আচরণ ও কাজের চাপ। অনেকে আবার মনে করেন, নেতৃত্বের দুর্বলতা বা ন্যায্য মূল্যায়নের অভাব থেকেও মতবিরোধ জন্ম নেয়।
ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা সাদিয়া রহমান বলেন, “অনেকে মনে করেন, দ্বন্দ্ব মানেই ঝগড়া। আসলে এটি অনেক সময় নীরব প্রতিযোগিতা বা ঠান্ডা যুদ্ধের মতো হয়। কাজের সময় সহযোগিতার অভাব, ইমেইলের উত্তর না দেওয়া বা অন্যের আইডিয়া নিজের বলে দাবি করা— এসবই একধরনের অফিস পলিটিক্স, যা ধীরে ধীরে মনোবল নষ্ট করে।”
উপেক্ষা নয়, সমাধান জরুরি
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক ম্যানেজার বা সুপারভাইজার দ্বন্দ্বের বিষয়টি উপেক্ষা করেন, যাতে তা “নিজে থেকেই মিটে যায়”। কিন্তু বাস্তবে সমস্যা তখনই আরও জটিল হয়। বিরোধ মেটাতে দেরি করলে সেটি ব্যক্তিগত হয়ে পড়ে, যা কাজের মানকে প্রভাবিত করে।
মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ নাজমুল হক বলেন, “দ্বন্দ্ব দেখা দিলে তা দ্রুত মোকাবিলা করা উচিত। প্রথমে দুই পক্ষের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলা, তারপর নিরপেক্ষভাবে বসে সমস্যা বোঝা, এভাবেই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হয়। উপেক্ষা করা মানে সমস্যাকে সময় দেওয়া, যাতে তা বেড়ে যায়।”
উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব
অফিসে বিরোধের প্রভাব শুধু মানসিক নয়, অর্থনৈতিকও। এক আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রের দ্বন্দ্বের কারণে প্রতি সপ্তাহে গড়ে একজন কর্মী ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময় নষ্ট করেন। বড় প্রতিষ্ঠানে এটি বছরে লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি ডেকে আনে।
এ ছাড়া দলীয় প্রকল্পে সহযোগিতা কমে যায়, সৃজনশীল চিন্তা বাধাগ্রস্ত হয় এবং নতুন ধারণা প্রকাশের আগ্রহও হারিয়ে ফেলে কর্মীরা। দীর্ঘমেয়াদে এসবের প্রভাব পড়ে কর্মদক্ষতা, কর্মী ধরে রাখার হার এবং প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর।
স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশই সমাধান
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাস্থ্যকর যোগাযোগ সংস্কৃতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও স্বচ্ছ নীতি থাকলে দ্বন্দ্বের পরিমাণ কমে আসে। নিয়মিত টিম মিটিং, ফিডব্যাক সেশন ও কর্মীদের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে এই ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো সম্ভব।
মনোবিজ্ঞানী তাসনুভা রুহি বলেন, “প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি ‘ওপেন কালচার’ থাকা জরুরি, যেখানে সবাই নিরাপদে কথা বলতে পারে। নীরব দ্বন্দ্বই সবচেয়ে বিপজ্জনক, কারণ তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙে ও কর্মস্থলকে বিষাক্ত করে তোলে।”
কর্মক্ষেত্রের এই অদৃশ্য চাপ মোকাবিলায় তাই প্রয়োজন সচেতন নেতৃত্ব, দ্রুত সিদ্ধান্ত ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। নীরবতা নয়, খোলামেলা আলোচনাই পারে দ্বন্দ্বকে পরিণত করতে উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের সুযোগে।










