প্যারিস: এক দশক আগেও প্রতিদিন সকালে চায়ের কাপের সঙ্গে যা ছিল অপরিহার্য, সেই ছাপানো খবরের কাগজটা আজ যেন একলা হয়ে পড়েছে। বারান্দায় বা দরজার ফাঁকে যত্ন করে রেখে যাওয়া কাগজওয়ালার সেই দৃশ্যটা এখন বিরল। এর জায়গা নিয়েছে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা খবরের নোটিফিকেশন। ব্যাপারটা এমন নয় যে মানুষ খবর পড়া ছেড়ে দিয়েছে; বরং খবর পড়ার ধরনটাই আমূল বদলে গেছে।
ঝড়ের বেগে এল ডিজিটাল, উড়ে গেল কাগজ
ভাবুন তো, আগে একটা বড় ঘটনা ঘটলে তার বিস্তারিত জানার জন্য আমাদের পরের দিনের কাগজের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। সেই উত্তেজনা বা উদ্বেগ নিয়ে রাত কাটাতাম। আর এখন? স্মার্টফোনে একটা ক্লিক করলেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খবর অডিও, ভিডিওসহ মুহূর্তের মধ্যে হাজির। এই “তাৎক্ষণিকতা” বা ইনস্ট্যান্ট নিউজের আকর্ষণই ছাপানো সংবাদপত্রের কফিনে প্রথম পেরেকটা ঠুকে দিয়েছে।
ডিজিটাল মাধ্যম শুধু দ্রুতই নয়, এটি অনেক বেশি সুবিধাজনক। বাসে-ট্রামে যেতে যেতে, কাজের ফাঁকে কিংবা মধ্যরাতেও মানুষ এখন খবর পড়ছে। ছাপানো কাগজের মতো নির্দিষ্ট সময় বা স্থানের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তরুণ প্রজন্ম, যারা স্মার্টফোন নিয়েই বড় হয়েছে, তাদের কাছে তো কাগজের পত্রিকা পড়াটা একটা সেকেলে ধারণা।
বিজ্ঞাপনের টাকায় টান পড়েছে
খবরের কাগজের আয়ের একটা বড় অংশ আসত বিজ্ঞাপন থেকে। কিন্তু বিজ্ঞাপনদাতারাও বুঝে গেছেন, যেখানে মানুষ বেশি, সেখানেই বিজ্ঞাপন দেওয়া লাভজনক। আজকাল সবাই যেহেতু ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবে সময় কাটাচ্ছে, তাই বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের বিজ্ঞাপনের বাজেট কাগজের পাতা থেকে সরিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ঢালছে। ফলে সংবাদপত্রের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডটাই ভেঙে পড়েছে। তাদের পক্ষে ছাপার খরচ, কাগজের দাম এবং কর্মীদের বেতন দেওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।
শুধু খবর নয়, চাই আরও কিছু
আজকের পাঠক শুধু একতরফা খবর পড়তে চায় না, তারা আলোচনায় অংশ নিতে চায়, মন্তব্য করতে চায়, ভিডিও দেখতে চায়। ডিজিটাল নিউজ পোর্টালে এই সবকিছুই সম্ভব। একটি খবরের নিচেই থাকে কমেন্ট বক্স, থাকে সম্পর্কিত আরও নানা খবরের লিঙ্ক, থাকে ঘটনার ভিডিও ফুটেজ। ছাপানো কাগজ এই প্রতিযোগিতায় স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে পড়েছে। এর স্থির, সাদাকালো দুনিয়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের রঙিন, চলমান এবং ইন্টারেক্টিভ জগতের কাছে আবেদন হারিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত, পরিবর্তনই জীবনের নিয়ম। একসময় ঘোড়ার গাড়ির জায়গা নিয়েছিল মোটরগাড়ি, টেলিগ্রামের জায়গা নিয়েছে ইমেল। ঠিক সেভাবেই, ছাপানো সংবাদপত্রও তার জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমকে। ভোরের সেই পরিচিত হকারের ডাক হয়তো একদিন রূপকথার গল্পের মতোই শোনাবে, আর ড্রয়িং রুমের টেবিলে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা হয়ে উঠবে শুধুই এক সোনালী অতীতের স্মৃতি।
প্যারিস শহরের ল্যাটিন কোয়ার্টারে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সংবাদপত্র বিক্রি করে আসা আলী আকবরকে দেশের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ ‘ন্যাশনাল অর্ডার অফ মেরিট’ সম্মানে ভূষিত করা হচ্ছে। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে আগত ৭৩ বছর বয়সী আলী আকবর হচ্ছেন ফ্রান্সের শেষ অবশিষ্ট সংবাদপত্র বিক্রেতা, যিনি আজকের ডিজিটাল যুগে হারিয়ে যাওয়া এক অপূরণীয় পেশার জীবন্ত প্রতীক।
১৯৭৩ সালে ফ্রান্সে পা রাখার পর থেকেই আলী আকবর প্যারিসের রাস্তার ধারে কাগজ বিক্রির কাজ শুরু করেন। সেসময় শহরের সড়কগুলো সংবাদপত্র বিক্রেতাদের ভরে ছিল। কিন্তু টেলিভিশন এবং পরবর্তীতে ইন্টারনেটের কারণে কাগজ পড়ার অভ্যাস হ্রাস পাওয়ায় আজ তারা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এর মাঝেও আলী আকবরের হাস্যরস ও আন্তরিক সেবা তাকে বিশেষ করে তোলে।
“আমি কাগজের স্পর্শ ভালোবাসি,” আলী আকবর বলেন। “ট্যাবলেট বা স্ক্রীনের চেয়ে বইয়ের আসল ছাপ অনেক আলাদা।” তিনি জানান, তিনি বিক্রির সময় গ্রাহকদের মজা করে হাসানোর চেষ্টা করেন, যা কেবল পকেট নয়, মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
তবে, প্রযুক্তির আধিক্য ও ডিজিটাল নিউজ প্ল্যাটফর্মের উত্থানে মুদ্রিত সংবাদপত্রের চাহিদা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আলী আকবর উল্লেখ করেন, বর্তমানে তিনি দিনে মাত্র ২০-৩০টি সংবাদপত্র বিক্রি করতে পারেন, যেখানে এক সময় এক ঘণ্টায় ৮০টিরও বেশি বিক্রি হতো। “আগে মানুষ আমার চারপাশে ভিড় করত, এখন আমি নিজে গ্রাহক খুঁজে বেড়াই,” তিনি অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।