কৃষ্ণা বসু, কলকাতা: অক্টোবরের শেষ লগ্ন, আর তার সঙ্গেই দার্জিলিং পাহাড় তার চিরাচরিত রূপে ধরা দিয়েছে পর্যটকদের কাছে। একদিকে ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্র হাসি, অন্যদিকে তাপমাত্রার পারদ নিম্নমুখী, যা শৈল শহরের হিমেল পরশকে আরও গভীর করে তুলছে। উৎসবের আমেজে জমজমাট দার্জিলিং সহ আশপাশের পর্যটনকেন্দ্রগুলি, যেন এক নিদারুণ প্রাকৃতিক চিত্রকলা।
মূল শহর তো বটেই, পকেট রুটের একাধিক জায়গাতেও হোটেল, হোমস্টেতে ঠাসা ভিড়। প্রতিটি কোণায় কান পাতলেই শোনা যায় পর্যটকদের উচ্ছ্বাস আর আনন্দের কলরব। মুখে এক স্বস্তির হাসি গাড়িচালকদেরও, কারণ তাঁদের ভাগ্যে জুটেছে উপরি পাওনা। কেউ কেউ একদিনে তিন ট্রিপে দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি এসে আবার দার্জিলিং ফিরছেন যাত্রী নিয়ে, যা তাঁদের মাস্কের আড়ালেও স্পষ্ট। চালকদের কথায়, চলতি মাসে গত দু’দিনেই নাকি সব চাইতে বেশি আয় হয়েছে—এই কথা নিছকই ভুল নয়, কারণ দার্জিলিংয়ের পথঘাটই তার প্রমাণ। ম্যাল রোড থেকে রিঙ্ক মল রোড, ভানু ভবন সংলগ্ন এলাকা, মহাকাল মন্দির—সর্বত্রই ঠাসা ভিড়, যেন মানুষের এক চলমান মেলা।

রবিবার বিকেলে এমনই এক পাহাড়ের গাড়িচালক সুরজ শর্মার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মেরেকেটে বয়স ৩০ হবে, পাহাড়ে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আট বছরের। তাঁর চোখেমুখে লেগে ছিল পরিশ্রম আর প্রাপ্তির মিশ্র এক ছাপ। রবিবার সুরজ তিন ট্রিপ ভাড়া পেয়েছেন তাঁর সাত আসনের গাড়িতে। সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে যাত্রী নিয়ে দার্জিলিং পৌঁছান। ওই পর্যটকদের নামিয়ে দিয়েই আবার দার্জিলিং থেকে যাত্রী নিয়ে শিলিগুড়িতে পৌঁছে দেন। বিকেলে দার্জিলিং ফেরার সময় আবার নতুন যাত্রীদের নিয়ে পাহাড়ে ওঠেন। সুরজের মুখে তখন এক অনাবিল তৃপ্তি, “এই মাসে আজই সবচাইতে বেশি ভাড়া হয়েছে। এবার হয়তো সিজনে ভালো ব্যবসা হবে।” তাঁর এই সরল উক্তিই যেন পাহাড়ের অর্থনীতির স্পন্দন।
মঙ্গলবার পর্যন্ত রাজ্যে টানা ছুটি। রবিবার এমনিতেই সাপ্তাহিক ছুটি, তার ওপর সোম এবং মঙ্গল দু’দিন ছটের ছুটি। তাই শনিবার অফিস শেষে অনেকেই পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার কোলে এক টুকরো শান্তির খোঁজে। ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখতে প্রচুর পর্যটক ভিড় করছেন। দার্জিলিং ম্যাল থেকে শুরু করে টয়ট্রেনের স্টেশন, ভানু ভবনের মহাকাল মার্কেট, চিড়িয়াখানা থেকে শুরু করে মন্দির, মনাসটেরিগুলোতে ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। হোটেলগুলিও যেন পর্যটকদের উষ্ণ আলিঙ্গনে ভিড়ে ঠাসা। তবে শুধু স্থানীয় হোটেলই নয়, ঘুম, বাতাসিয়া লুপ সংলগ্ন হোমস্টে, একটু অফবিট এলাকার হোমস্টে, কার্সিয়াংয়ের বিভিন্ন হোটেলেও উপচে পড়া ভিড়।
রবিবার বিকেলে সূর্য অস্ত না যাওয়া পর্যন্ত ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিলেছে, তার প্রতিটি রেখা স্পষ্ট, প্রতিটি চূড়া যেন হাতছানি দিচ্ছিল। সোমবার সকালে কিছুক্ষণ দেখা গেলেও দুপুরের দিক থেকে মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছিল ঘুমন্ত বুদ্ধ, যেন এক রহস্যময় আবরণে নিজেকে ঢেকে রেখেছিল। তবে সকাল ১০টার পর থেকে তাপমাত্রার পারদ নামতে থাকে দার্জিলিংয়ে। বেলা যত গড়িয়েছে ততই শীতল হয়েছে শৈল শহর, বাতাস হয়ে উঠেছিল আরও স্নিগ্ধ। দার্জিলিংয়ের পাশাপাশি ঘুম, সোনাদা, এমনকি কার্সিয়াংয়েও এদিন তাপমাত্রার পারদ অনেকটাই নেমেছিল, যেন প্রকৃতি তার নিজস্ব ছন্দে এক হিমেল উৎসবের আয়োজন করেছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে মা-বাবাকে নিয়ে দার্জিলিং এসেছেন সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়। মহাকাল মন্দিরে উঠে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তাঁর বছর ৬৫-র মা। তবে কিছুক্ষণ বসে, জল খাওয়ার পর তিনি সুস্থ বোধ করেন এবং মহাকাল মন্দিরে পুজোও দেন তাঁরা। সুপ্রিয়র কথায়, “আমার মা-বাবা কোনওদিন পাহাড়ে আসেননি। চারদিনের ছুটি মিলেছে। তাই ওঁদের নিয়ে চলে এসেছি ঘুরতে।” এই ধরনের ছোট ছোট গল্পই প্রমাণ করে, দার্জিলিং কেন আজও বাঙালির কাছে এক আবেগ, এক ভালোবাসার ঠিকানা। কাঞ্চনজঙ্ঘার অপার সৌন্দর্যে, হিমেল হাওয়ার পরশে আর টয়ট্রেনের বাঁশির সুরে, দার্জিলিং যেন প্রতিবারই নতুন করে তার জাদু বিস্তার করে।
 
            









