রামেশ ভট্টরায়, কাঠমান্ডু: ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নেপালে এক সিদ্ধান্ত দেশটির তরুণ প্রজন্মকে ঝড়ের গতিতে রাস্তায় নামায়। সরকার হঠাৎ করে ২৬টি সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধের ঘোষণা দেয়। বিষয়টি তরুণদের কাছে কেবল প্রযুক্তি-সংক্রান্ত অসুবিধা ছিল না; এটি তাদের মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে ধরা পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ক্ষোভ অনলাইনের সীমা ছাড়িয়ে মাঠে নেমে আসে। কাঠমাণ্ডু, ললিতপুর ও পোখরার রাস্তায় হাজার হাজার তরুণ–তরুণী বিক্ষোভে যোগ দেন। কয়েক দিনের মধ্যেই নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং আন্দোলনটি সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সহিংস ঘটনার রূপ নেয়।
সিদ্ধান্ত ও আন্দোলনের প্রথম বিস্ফোরণ
৪ সেপ্টেম্বর সরকার যখন সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করে, নেটব্যবহারকারী তরুণ সমাজ মুহূর্তেই প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। উচ্চ বেকারত্ব, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এবং দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অচলাবস্থায় আগে থেকেই ক্ষুব্ধ তরুণরা এই সিদ্ধান্তকে ক্ষমতাসীনদের স্বচ্ছতা এড়ানোর কৌশল হিসেবে দেখে। অনলাইনে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা সড়কের বিক্ষোভে রূপ নেয়।
৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে। পুলিশ টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং জলকামান ব্যবহার করে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। সংঘর্ষে বহু হতাহত হয়। নেপালের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন সহিংসতা খুব কমই দেখা গেছে।
৯ সেপ্টেম্বর চাপের মুখে সরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। তবে এই প্রত্যাহার উত্তেজনা কমাতে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। বরং সমাজের সামনে বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে—দেশটির তরুণরা কি কেবল ক্ষণস্থায়ী ক্ষোভ দেখালো, নাকি এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হলো?
তরুণদের ক্ষোভ এত দ্রুত বিস্ফোরিত হল কেন
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা: দীর্ঘদিন ধরে নেপালে তরুণ বেকারত্ব বড় সমস্যা। কাজের সুযোগ কম, দক্ষতার ব্যবহার আরও কম। ফলে তরুণদের মধ্যে হতাশা গভীর হয়ে উঠেছে।
দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি: দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক পরিবারের আধিপত্য নিয়ে ক্ষোভ ছিল। তরুণরা মনে করেন, তাদের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর হাতে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীলতা: অনেক তরুণের আয়ের পথ, শিক্ষা এবং সামাজিক সংযোগ—সবই ডিজিটাল মাধ্যমনির্ভর। তাই হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা মানে জীবনযাত্রার উপর সরাসরি আঘাত।
ডিজিটাল প্রজন্মের সংগঠনী শক্তি: সামাজিক মাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্তই paradoxically আন্দোলনকে আরও বড় করে তোলে—কারণ নিষেধাজ্ঞার ঠিক আগমুহূর্তে পোস্ট, ভিডিও ও বার্তা ভাইরাল হয়ে দ্রুত সমর্থন জড়ো করে।
আন্দোলনের ধরন
নেতাহীন, তরুণ-নির্ভর আন্দোলন হিসেবে এটি বিশেষ পরিচিতি পেয়েছে। কোনো বড় রাজনৈতিক দল এতে নেতৃত্ব দেয়নি। বরং বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া, অনলাইন উদ্যোক্তা, তরুণ পেশাজীবী এবং সাধারণ ব্যবহারকারীরাই নেতৃত্বে থাকেন।
অনলাইন-অফলাইন মিশ্র কৌশলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। অনলাইনে আহ্বান, রাস্তায় বিক্ষোভ, আবার মাঠ থেকে ভিডিও প্রচার—সব মিলিয়ে আন্দোলনকে অন্যরকম গতিশীলতা দেয়।
তরুণদের মূল দাবি ছিল: বাকস্বাধীনতা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, স্বচ্ছ নীতি গ্রহণ, এবং ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার প্রতিশ্রুতি।
সরকারি প্রতিক্রিয়া
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলেও সহিংস দমনপদ্ধতির সমালোচনা তীব্র হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে। আন্তর্জাতিক মহলও নেপালের ওপর নজর রাখছে।
দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা
এই আন্দোলন কেবল সামাজিক মাধ্যম নিষেধাজ্ঞা কেন্দ্রিক ছিল না—এটি নেপালের তরুণ সমাজের গভীর হতাশা, চাপা ক্ষোভ এবং পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যতে নেপালে নতুন তরুণ-নির্ভর রাজনৈতিক শক্তির উত্থান দেখা যেতে পারে। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে সরকারকে আরও স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নীতি গ্রহণে বাধ্য করতে পারে।
উপসংহার
২০২৫ সালের নেপালের তরুণ আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে—ডিজিটাল যুগে কোনো নীতি জনমানসে গ্রহণযোগ্য না হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা ব্যাপক অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে। নেপালের তরুণরা প্রমাণ করেছে তারা কেবল দর্শক নয়; তারা নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্তে অংশ নিতে চায়। নেপালের এই অভিজ্ঞতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ—তরুণদের উপেক্ষা করলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে, আর তাদের সঙ্গে নিয়ে এগোলে ভবিষ্যৎ আরও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে।










