ধারাবাহিক প্রতিবেদন: পবিত্র আহ্বানের পথে পর্ব-৩
মওলানা মোহাম্মদ কাউসার: হজ মানেই মক্কা আর মদিনা। মুসলিম হৃদয়ের কেন্দ্রস্থল এই দুই নগরী। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের মুসলমানদের হৃদয়ে যেসব শহরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আকর্ষণ সবচেয়ে গভীর, তাদের নাম মক্কা ও মদিনা। হজের সফর মানে শুধু একটি নির্ধারিত ইবাদত নয়, বরং নবীজির স্মৃতিমাখা এই দুই নগরীর আত্মিক ছোঁয়া লাভ করা।
মক্কা: পৃথিবীর প্রথম ঘর, তাওহিদের প্রতীক:
মক্কা নগরী অবস্থিত সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে, পাহাড়বেষ্টিত মরুভূমির বুকজুড়ে। এখানেই কাবা শরিফ অবস্থিত, যাকে বলা হয় ‘বাইতুল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর ঘর। মুসলমানেরা এখানেই মুখ করে নামাজ পড়ে। কাবা শরিফ ঘিরেই হয় তাওয়াফ।
কাবা প্রথম তৈরি করেন হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)। আল্লাহ তাআলা তাঁদের মাধ্যমে এই পবিত্র ঘর স্থাপন করান, যা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক। কাবার পাশে অবস্থিত ‘মাকামে ইব্রাহিম’ এবং কিছু দূরে ‘জামজাম কূপ’, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হজরত হাজেরা (আ.) ও শিশু ইসমাইলের পিপাসার স্মৃতি।
মক্কা নগরীতে হজের সময় বিভিন্ন স্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মিনায় অবস্থান, কঙ্কর নিক্ষেপ, মুজদালিফায় রাত যাপন, আরাফাতের ময়দানে উপস্থিতি এসবের সবই মক্কার উপকণ্ঠে। এই শহর হজের মূল কিয়দংশ ধারণ করে।
মদিনা: শান্তির শহর, নবীজির ভালোবাসার আবাস:
মদিনা শহরের মূল নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’। হিজরতের পর হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ নগরীকে ইসলামের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন। এখানে অবস্থিত মসজিদে নববী, যেখানে রয়েছে রাসুল (সা.)-এর রওজা মোবারক।
মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করা খুবই ফজিলতপূর্ণ। রাসুল (সা.) বলেন, “আমার এই মসজিদে এক রাকাত নামাজ, অন্য মসজিদে এক হাজার রাকাত নামাজের চেয়েও উত্তম।”
এখানে রয়েছে ‘রাওজা’, যাকে জান্নাতের বাগিচা বলা হয়—“মিম্বর আর আমার ঘরের মধ্যবর্তী স্থানটি জান্নাতের একটি বাগিচা।” এ কথায় বুঝা যায়, মদিনা সফর হজের একটি মহাসুযোগ। যদিও এটি হজের ফরজ অংশ নয়, তবে প্রায় সকল হজযাত্রী মদিনা গমন করেন, অন্তত কিছুদিন থেকে নবীজির রওজায় সালাম জানান।
দুই নগরীর পার্থক্য ও মিল:
মক্কা আর মদিনা—দুই নগরী ভিন্ন বৈশিষ্ট্যধারী হলেও তারা পরস্পরের পরিপূরক। মক্কা কাবার শহর, যেখানে তাওহিদের আহ্বান। মদিনা হলো রাসুলের শহর, যেখানে মিলেছে নবুয়তের বাস্তব রূপ।
মক্কায় রয়েছে গাম্ভীর্য, ভয় ও আবেগের ছোঁয়া—কারণ এটি আল্লাহর ঘরের নগরী। আর মদিনায় রয়েছে প্রশান্তি ও ভালোবাসার আবেশ—যেখানে নবীজির স্মৃতি, সাহাবাদের পদচিহ্ন আর ইসলামের প্রথম রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
হজযাত্রীদের অনুভূতি:
প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ মক্কা ও মদিনার দিকে ছুটে যান। অনেকে জীবনের একমাত্র সুযোগ হিসেবে হজে যান। কাবা শরিফ প্রথম দর্শনে চোখের পানি ঝরে পড়ে, নবীজির রওজা দেখে আবেগে বুক কেঁপে ওঠে। অনেকের কাছে এই সফর জীবনের মোড় ঘোরানো ঘটনা হয়ে থাকে।
মক্কা ও মদিনা কেবল দুই শহরের নাম নয়—তারা মুসলমানদের আত্মিক ঠিকানা। হজের মূলতত্ত্ব বোঝার জন্য এই দুই শহরের ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য ও মাহাত্ম্য জানা অত্যন্ত জরুরি। তখনই হজের সফর হয়ে ওঠে পূর্ণাঙ্গ, হৃদয় ছোঁয়া এবং অর্থবহ।
পরবর্তী পর্ব: হজের প্রতিটি ধাপ: ইহরাম থেকে তাওয়াফ