বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম): সীতাকুণ্ডে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বন উজাড় করে গড়ে তোলা কোহিনূর স্টিলের অবৈধ শিপব্রেকিং ইয়ার্ড অবশেষে উচ্ছেদ করেছে জেলা প্রশাসন। বুধবার (২৫ জুন) মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে এই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল আমিন ও মো. মঈনুল হাসান।
উচ্ছেদের সময় ওই এলাকায় নির্মিত দুই তলা ভবনসহ পুরো স্থাপনাটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। অভিযানে সীতাকুণ্ড উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল আমিন বলেন, “তুলাতলি মৌজার যে খাসজমিতে স্থাপনাটি নির্মিত হয়েছিল, সেটি শিল্প জোনের বাইরে এবং অবৈধভাবে দখল করা হয়েছিল। তাই জেলা প্রশাসকের নির্দেশে তা ভেঙে ফেলা হয়েছে।”

কিন্তু এটি নতুন ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ বিতর্কিত ইতিহাস ও পরিবেশ লঙ্ঘনের অভিযোগ। ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কোহিনূর স্টিলকে পাঁচ একর জমি ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু অভিযোগ ওঠে, ইজারার অধিকাংশ জমি শিপব্রেকিং জোনের বাইরের তুলাতলি মৌজায় অবস্থিত, যেখানে কোনো ধরনের ইয়ার্ড স্থাপন নিষিদ্ধ।
২০২৩ সালের ২৯ মে এক উচ্ছেদ অভিযানে কোহিনূর স্টিলের ইয়ার্ড ভেঙে দেওয়া হয় এবং ১ জুন ইজারা বাতিল করা হয়। এরপরও ২০২৪ সালের মার্চে প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবুল কাশেম ওরফে রাজা কাশেম বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আপিল করলে ফের ইজারা ফিরে পান তিনি। অথচ ওই জমি নিয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞাও ছিল।
পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেলা) ২০২৪ সালের মে মাসে এই ইজারাকে কেন্দ্র করে আদালত অবমাননার অভিযোগ দায়ের করে। এর আগেও বেলা ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি জনস্বার্থে মামলা করে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা আদায় করে, যেখানে বলা হয়—এই ইজারা প্রক্রিয়া অবৈধ এবং বনভূমি সংরক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসন ও বন বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
একই মালিকানাধীন আরেক প্রতিষ্ঠান বিবিসি স্টিল ২০১৮ সালে উত্তর সলিমপুর মৌজার ২১ দশমিক ৫৭ একর জমি ইজারা চায়। তবে সীতাকুণ্ড ভূমি অফিস জানায়, জমিটি তুলাতলি মৌজার অংশ এবং উপকূলীয় এলাকা, যা শিপব্রেকিং শিল্পের নির্ধারিত অঞ্চলের বাইরে।
বনবিভাগের আপত্তি সত্ত্বেও ২০১৯ সালে আবারও ৭ দশমিক ১০ একর জমির ইজারা দেওয়া হয় বিবিসি স্টিলকে, যা পরে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, উপকূলীয় বন উজাড় করে এমন অবৈধ শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ শুধু পরিবেশ ধ্বংস করছে না, বরং সরকারি সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ সমন্বয়হীনতা এবং প্রভাবশালীদের রাজনৈতিক দাপটও স্পষ্ট করে তুলছে। এ ধরনের পদক্ষেপ কেবল বন বা ভূমির ক্ষতিই করে না, আইনের শাসনেরও অবমূল্যায়ন করে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ অভিযানে এটি স্পষ্ট যে, প্রশাসন অবশেষে সক্রিয় হয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—বহুবার উচ্ছেদের পরেও কীভাবে একই ব্যক্তি বারবার জমির ইজারা ফিরে পান, এবং বন উজাড়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও কিভাবে তা উপেক্ষিত থাকে?
অবশ্য কোহিনূর স্টিলের মালিক এম এ কাশেম রাজা এই উচ্ছেদকে প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে দাবি করেছেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সরকারের বিদ্যমান নীতিমালার আলোকে তার প্রতিষ্ঠান ইজারা নেয় এবং গ্রিন শিপইয়ার্ড প্রতিষ্ঠার বাধ্যবাধকতা মেনেই অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। তিনি জানান, পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্থাপনার অনুমোদন সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর থেকে নিয়ম অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও দাবি করেন, “যে ভবনটি ভাঙা হয়েছে তা উত্তর সলিমপুর মৌজায় অবস্থিত, তুলাতলি মৌজায় নয়। আগের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা তদন্ত করে যে সার্ভে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, তাতেও উত্তর সলিমপুর মৌজার উল্লেখ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি একটি মহল আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।”
তার ভাষ্য মতে, এই ইজারা ও ভবন সংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলা চলমান রয়েছে। “এমন একটি মামলার বিচারাধীন অবস্থায় ভবন ভাঙার সিদ্ধান্ত কিভাবে নেওয়া হলো, তা আমার বোধগম্য নয়”—বলেন এম এ কাশেম রাজা।