Home First Lead গাজীপুরের সাংবাদিক তুহিন হত্যা: তদন্তে নতুন তথ্য, হানি ট্র্যাপ চক্রের ছায়া

গাজীপুরের সাংবাদিক তুহিন হত্যা: তদন্তে নতুন তথ্য, হানি ট্র্যাপ চক্রের ছায়া

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, গাজীপুর:  বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় দৈনিক প্রতিদিনের গাজীপুর প্রতিনিধি মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে। ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার (৮ আগস্ট) লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘটনার পরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চাঁদাবাজির কণ্ঠস্বর, কিন্তু পুলিশি প্রাথমিক তদন্ত সংবাদ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মিলিয়ে দেখা যায় হত্যার মূল সূত্রপাত ছিল হানি ট্র্যাপ থেকে, এবং তুহিন ভিডিও ধারণ করায় সন্ত্রাসীরা প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে।

ঘটনাক্রম ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
তুহিন ও তার সহকর্মী মো. শামীম হোসেন ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বসে ছিলেন। স্থানীয়রা বলছেন সন্ধ্যার দিকে বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এক নারীর সঙ্গে বিবাদ সৃষ্টি হয়। ওই নারীকে আঘাত করার ঘটনায় আশপাশের কয়েকজন সশস্ত্র যুবক পাল্টা আক্রমণ চালান। তুহিন ঘটনাটি মোবাইলে ভিডিও করছিলেন। সূত্র বলছে, সশস্ত্ররা ভিডিওটি দেখতে পেয়ে তাকে ভিডিও মুছে ফেলতে বলে। তুহিন অস্বীকৃতি জানালে তাকে ধাওয়া করে তরুণেরা, দৌড়ানোর সময় তিনি একটি দোকানে ঢুকে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলে সেখানে ভয়ার্ত পরিবেশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় আশেপাশে বহু মানুষ থাকলেও সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের ভয়ে কেউ এগিয়ে আসতে পারেনি।

পুলিশি তথ্য ও গ্রেপ্তার
বাসন থানায় নিহতের বড় ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ২০–২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। পুলিশ ইতোমধ্যে পাঁচজন সন্দেহভাজনকে আটক করেছে এবং সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইল রেকর্ড ও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ যাচাই করে খুনিদের শনাক্তে কাজ করছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) রবিউল হাসান অপরাধের তদন্তে নিয়োজিত দলের কাজের অগ্রগতি নিয়ে জানিয়েছেন দ্রুততম সময়ে দোষীদের গ্রেপ্তার করা হবে। বাসন থানার ওসি শাহীন খান স্পষ্ট করে বলেছেন এটি চাঁদাবাজির ঘটনাসংক্রান্ত নয়, বরং হানি ট্র্যাপের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিশোধমূলক আক্রমণ।

হানি ট্র্যাপ চক্রের কার্যপদ্ধতি ও স্থানীয় উদ্বেগ
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গোলাপী নামক ওই নারী দীর্ঘদিন ধরে হনিভূমে মানুষকে টার্গেট করে আসছিলেন, কৌশলে সম্পর্ক গড়ে তোলার পর সহযোগীদের নিয়ে ফাঁদ পেতেন এবং শারীরিক ও আর্থিক নির্যাতন ঘটাতেন। পুলিশি প্রাথমিক তদন্তে এই চক্রের অস্তিত্ব উঠে এসেছে, এবং এই চক্রের সঙ্গে কোনো হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া বঞ্চিত বা প্রতিহিংসামূলক ভাবে সংঘটিত হয়েছে মনে করা হচ্ছে। এলাকাবাসী অভিযোগ করছেন পূর্বেও এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু প্রশাসনিক নজরদারি পর্যাপ্ত ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড স্থানীয়দের মধ্যে নীরব আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।

সাংবাদিক সমাজ ও পরিবারের দাবি
গাজীপুর প্রেস ক্লাব এবং সাংবাদিক ইউনিয়ন দ্রুত সময়ের মধ্যে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। তারা দাবি করেছে সাংবাদিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না হলে সংবাদ সংগ্রহের কাজ বিপন্ন হবে। নিহতের বড় ভাই মো. সেলিম প্রশাসনের কাছে দ্রুত বিচারের দাবি তুলেছেন এবং দোষীদের প্রতি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আহ্বান জানিয়েছেন। স্থানীয় নেতারা বলেছেন, পরিবারটি শোকাহত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত সহায়তা ও নিরাপত্তা বর্ধনের অনুরোধ করা হয়েছে।

নিরাপত্তা প্রশ্ন, প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া ও সুপারিশ
এই ধরনের প্রকাশ্য হিংসা সামাজিক স্বাভাবিকতা ভাঙে এবং ছোট শহরগুলোতে গণতান্ত্রিক সংবাদ পরিবেশের জন্য বড় সঙ্কেত বয়ে আনে। তদন্তের শুরুর দিনগুলোতে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয়ভাবে সিসিটিভি বিশ্লেষণ, মোবাইল কল ডাটা তল্লাশি, ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজনদের গতিবিধি অনুসরণ ও প্রমাণসংগ্রহে তৎপর হতে হবে। অপরদিকে পুলিশি উপস্থিতি বাড়িয়ে চান্দনা এলাকায় গণপরিচালিত স্পটলাইট স্থাপন, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও পথচারীদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ টহল জোরদার করা ও সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট নিরাপত্তা নির্দেশিকা জারি করা জরুরি। স্থানীয় প্রশাসন ও সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে সমন্বিত কমিটি গঠন করে ঘটনার বারবারতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

তুহিনের নির্মম মৃত্যু শুধু একটি পরিবারকে শোকগ্রস্ত করেনি, বরং একটি শহরের মতামত ও সাংবাদিক সমাজকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ভাবিয়ে তুলেছে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে স্থানীয় মানুষের মনোবল ও সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ দুটোই রক্ষা পাবে। পুলিশ ও প্রশাসনের ডিজিএমপি পর্যায়ে দ্রুততর এবং স্বচ্ছ তদন্তই এখন প্রধান লক্ষ্যে থাকতে হবে।