আহমেদ করিম, নোয়াখালী: ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের আগের বছর, ভয়াবহ দাঙ্গা নেমে এসেছিল পূর্ব বাংলার নোয়াখালী অঞ্চলে। মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া এই সহিংসতায় প্রাণ হারান অসংখ্য মানুষ, ভাঙে ঘরবাড়ি, ছিন্নভিন্ন হয় সামাজিক বন্ধন। এই বিভেদের আগুন নিভাতে ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়েই মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এসেছিলেন নোয়াখালীতে। সঙ্গে ছিল একটি ছাগল যেটি পরে এক অদ্ভুত, করুণ, কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।
গান্ধীজির খাদ্যাভ্যাস ছিল কঠোরভাবে নিরামিষ এবং প্রাকৃতিক। তিনি নিয়মিত ছাগলের দুধ পান করতেন, কারণ তা ছিল সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যকর। যেখানেই তিনি যেতেন, সেখানেই তার সঙ্গে যেত তার প্রিয় ছাগলটি। ছাগলটি যেন গান্ধীজির চলমান জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল এক বিশ্বনেতার সরল জীবনের নিদর্শন।

নোয়াখালীতে যখন তিনি গ্রাম থেকে গ্রাম ঘুরে ঘুরে শান্তির বাণী প্রচার করছিলেন, তখনও ছাগলটি তার পাশে ছিল। ছাগলটি শুধুই তার দুধের উৎস ছিল না, বরং গান্ধীজির নীতিগত জীবনের এক নিঃশব্দ সঙ্গী। তবে এই ছাগলের ভাগ্যে লেখা ছিল এক ব্যতিক্রম পরিণতি।
জনশ্রুতি ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, একদিন গান্ধীজির অনুপস্থিতিতে তার প্রিয় ছাগলটি স্থানীয় কয়েকজন মানুষ জবাই করে ফেলে এবং সেই মাংস রান্না করে খেয়ে ফেলে। এটি ছিল নিছক খাদ্যের জন্য নয়, বরং অনেকে মনে করেন, এতে রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিবাদের এক ছায়া ছিল। আবার কেউ বলেন, এটি ছিল নিছক ভুল বোঝাবুঝি কিংবা ক্ষুধার নির্মম প্রকাশ।
গান্ধীজি যখন জানতে পারলেন তার ছাগল জবাই করা হয়েছে, তিনি গভীরভাবে আহত হন তবে প্রতিক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ অহিংস। তিনি কাউকে দোষারোপ করেননি, বরং এটিকে দেখেছিলেন সমাজের একটি গভীর অসুখের লক্ষণ হিসেবে। সেই সময়ে তার আশপাশে থাকা কর্মী ও অনুসারীরা লক্ষ্য করেছিলেন, গান্ধীজির চোখে ছিল দুঃখ ও বিষণ্নতা, কিন্তু সেই সাথে ছিল সহানুভূতি।
এই ঘটনাটি তার দাঙ্গাবিরোধী অভিযানে আরও এক মানবিক রং যোগ করেছিল। কারণ, যেখানে মানুষ ধর্মীয় বিভেদে জড়িয়ে একে অপরকে হত্যা করছে, সেখানে এক নির্বোধ প্রাণীর প্রতি সহানুভূতির অভাব যেন বড় প্রতীক হয়ে উঠল। এটি যেন গান্ধীজির সেই বার্তাকেই তুলে ধরল ‘অহিংসা শুধু মানুষের জন্য নয়, সমস্ত জীবের প্রতিও প্রযোজ্য।’
নোয়াখালীর মানুষ আজও স্মরণ করেন সেই ঘটনাকে, যদিও সময়ের ধুলায় তা অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। ইতিহাসের বড় ক্যানভাসে এটি হয়তো ছোট্ট একটি ঘটনা, কিন্তু তা যেন গান্ধীজির দর্শন ও ত্যাগের প্রতিচ্ছবি হয়ে রয়েছে। নোয়াখালী আজও সেই ক্ষণিক উপস্থিতির স্মৃতি ধরে রেখেছে যেখানে একজন বৃদ্ধ স্বাধীনতাসংগ্রামী মানুষের চোখে জল এসেছিল একটি ছাগলের জন্য।
গান্ধীজির সেই ছাগল জবাই হয়ে গেলেও তার অহিংসা ও মানবতার বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল জনে জনে। এই একটিমাত্র ঘটনা যেন ইতিহাসকে আরও মানবিক করে তোলে। আমরা ভুলে গেলেও, ইতিহাস কিন্তু মনে রাখে সেইসব ক্ষুদ্র অথচ গভীর প্রতীক, যেগুলো বড় পরিবর্তনের সূচনা করে।