বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার: দেশের চা-বাগান শিল্পের চালিকা শক্তি নারী শ্রমিকরা। তাদের ঘাম ও শ্রমে এগিয়ে চলছে দেশের ঐতিহ্যবাহী চা শিল্প। অথচ এই নারীরাই এখনও বঞ্চিত মৌলিক অধিকার থেকে—খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ন্যায্য মজুরি। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের কুরমা চা-বাগানের সমাজকর্মী গীতা রানী কানু।
গীতা নিজেও চা-জনগোষ্ঠীর সন্তান। ৪৩ বছর বয়সেও অবিবাহিতা এই নারী নিজেকে উৎসর্গ করেছেন অসহায় মানুষের সেবায়। কখনও অসুস্থ শ্রমিকের পাশে চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে গেছেন, কখনও ক্ষুধার্ত পরিবারের হাতে খাবার তুলে দিয়েছেন। আবার কখনও মাঠে নেমে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্দোলনে।
তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বাংলাদেশ চা-শ্রমিক নারী ফোরাম’, যেখানে বর্তমানে পাঁচ হাজারেরও বেশি নারী সদস্য রয়েছেন। সংগঠনটি নারী শ্রমিকদের অধিকার সচেতনতা, দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন এবং স্বনির্ভর কর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
গীতা রানী জানান, ছোটবেলা থেকেই মানবসেবায় অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি। “আমার বাবা নিজের কোম্পানি থেকে খাবার এনে অনাহারীদের দিতেন, আর মা নারীর অধিকার নিয়ে রাজনীতি করতেন। তাদের কাছ থেকেই আমি শিখেছি মানুষ ও সমাজের জন্য কাজ করতে হয়,” বলেন তিনি।
কৈশোর থেকে প্রায় ১৭ বছর দোকানদারী করেছেন গীতা। সেই সময়ের কষ্ট ও অভাব তাঁকে মানুষের দুঃখ বুঝতে সাহায্য করেছে। “দেখতাম, চা-বাগানের নারী শ্রমিকরা দিনের পর দিন কাজ করছে, কিন্তু সঠিক মজুরি পাচ্ছে না। তখনই সিদ্ধান্ত নিই—তাদের জন্য সংগঠন গড়বো,” বলেন গীতা।
২০০৭-০৮ সালে তিনি ‘থাল-বাসনের হরতাল’ নামে এক অনন্য আন্দোলনের সূচনা করেন, যা চা-শ্রমিক নারীদের অধিকার আদায়ের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ২০১৪ সালে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে ৪১ হাজার ভোট পেয়েও ষড়যন্ত্রের শিকার হন। ২০২৪ সালেও আবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে একই পরিণতি বরণ করতে হয়।
তবুও তিনি দমে যাননি। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো চা-শ্রমিকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বাংলাদেশ চা শ্রমিক সংগঠনের সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।
গীতা বলেন, “চা শিল্পের নামে বড় বড় প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা আয় করছে, অথচ এই শিল্পে যারা পরিশ্রম করে তাদেরই প্রাপ্য কিছু নেই। আমরা কি চিরকাল শূন্য হাতে থাকবো? তাই আমি শুধু ওদের জন্যই আবারও নির্বাচনে দাঁড়াবো।”
ভবিষ্যতে নারীদের জন্য তাঁতশিল্পভিত্তিক কর্মসংস্থান গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথাও জানান গীতা রানী। “আমি চাই, চা-বাগানের নারীরা যেন নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে, নিজের ভাগ্য নিজেরাই গড়তে পারে,”—বললেন এই সংগ্রামী নারী, যিনি আজও নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে চলেছেন সমাজ ও নারী শ্রমিকদের অধিকারের জন্য।