বিশেষ ফিচার প্রতিবেদন
তারিক-উল-ইসলাম:
প্রকৃতির রঙিন ক্যানভাসে মাঝে মাঝে কিছু এমন বিরল সৃষ্টি দেখা দেয়, যা মানুষকে বিস্ময়ে অভিভূত করে। তেমনই একটি সৃষ্টি ‘গোলাপি হাতি’। বাস্তবেই কি গোলাপি হাতি রয়েছে? এটি কি কোনো রূপকথা, নাকি প্রকৃতির জিনগত এক ব্যতিক্রমী উপহার? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সামনে আসে ‘অ্যালবিনো হাতি’র তথ্য, যার শরীরের বর্ণ গোলাপি বা ফ্যাকাশে সাদা।
অ্যালবিনো হাতি: গোলাপি রঙের রহস্য
গোলাপি হাতি বলতে প্রকৃতপক্ষে বোঝানো হয় অ্যালবিনো হাতিকে। এটি কোনো আলাদা প্রজাতি নয়, বরং এক ধরনের জিনগত অবস্থার ফল। অ্যালবিনিজম হলো এমন একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে প্রাণীর শরীরে মেলানিন নামক রঞ্জক পদার্থের অভাব থাকে। এই মেলানিনই ত্বক, চুল, চোখের রঙ নির্ধারণ করে। যখন এই উপাদান অনুপস্থিত বা অত্যন্ত কম থাকে, তখন ত্বক হয় হালকা গোলাপি বা ফ্যাকাসে সাদা।
অ্যালবিনো হাতিরা সাধারণত হালকা বাদামী বা ধূসর বর্ণের সাধারণ হাতিদের চেয়ে ভিন্ন রঙের হয়, এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদের চোখও গোলাপি বা লালচে দেখায়।
কোথায় দেখা যায় এই বিরল প্রাণী?
বিশ্বের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে বিরল এই গোলাপি হাতি দেখা যায়। বিশেষ করে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও লাওসের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। তবে সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কে একটি গোলাপি বাচ্চা হাতিকে ক্যামেরাবন্দি করা হয়, যা বিশ্বব্যাপী আলোচনার জন্ম দেয়। স্থানীয় গাইডরা জানান, এই বাচ্চাটি সম্ভবত এক বছরের মতো বয়সী এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেই চলাফেরা করছে।
এই দৃশ্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বন্য পরিবেশে অ্যালবিনো প্রাণীর টিকে থাকা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত সূর্যালোক, শত্রুদের নজর, এবং খাদ্য সংগ্রহে সমস্যার কারণে তারা বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ে।
থাই সংস্কৃতিতে গোলাপি হাতির মাহাত্ম্য
থাইল্যান্ডে গোলাপি হাতিকে শুধুমাত্র একটি প্রাণী হিসেবে নয়, বরং একধরনের রাজকীয় প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। থাই ভাষায় এদের বলা হয় “চাং সমখান”, অর্থাৎ ‘পবিত্র বা শুভ হাতি’। ঐতিহাসিকভাবে, রাজা বা মহারাজাদের কৃতিত্ব ও সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসেবে এসব হাতিকে উপস্থাপন করা হতো।
রাজকীয় গোলাপি হাতি পাওয়ার অর্থ হলো, কোনো শাসকের অধীনে রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে এবং জাতির ভাগ্য উন্নতির দিকে। এ কারণে কোনো ব্যক্তি যদি রাজাকে একটি গোলাপি হাতি উপহার দেয়, তাহলে তাকে বিপুল সম্মান দেওয়া হয়।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন
অ্যালবিনিজম শুধু হাতির মধ্যেই নয়, অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও দেখা যায়—যেমন হরিণ, বানর, কুমির বা এমনকি পাখির মধ্যেও। তবে হাতির মতো বৃহৎ ও দৃষ্টিকাড়া প্রাণীর মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য থাকলে তা দর্শকদের কাছে আরও বিস্ময়কর হয়ে ওঠে।
গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যালবিনো হাতির সংখ্যা পুরো হাতি জনগোষ্ঠীর এক শতাংশেরও কম। সাধারণত অ্যালবিনিজম বংশানুক্রমিকভাবে ঘটে এবং প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কিছুটা হ্রাস পায়, কারণ তাদের শরীর সূর্যালোক প্রতিরোধে অক্ষম হয়।
রাঙ্গামাটির বরুনাছড়িতে বিরল গোলাপি হাতি
বাংলাদেশের পাহাড়ি অরণ্যে প্রথমবারের মতো দেখা মিলেছে প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়—একটি গোলাপি রঙের বন্য হাতির শাবক। রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার বরুনাছড়ি ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ে এই বিরল প্রজাতির হাতির জন্ম প্রাণী ও প্রকৃতি গবেষকদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে অ্যালবিনো বা গোলাপি হাতির অস্তিত্ব sporadically থাকলেও, বাংলাদেশে এটিই প্রথম রেকর্ড করা ঘটনা।
কীভাবে দেখা মিলল গোলাপি হাতির?
১৩ জুন সকালে কাপ্তাই হ্রদ পাড়ি দিতে থাকা একদল হাতির মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী রঙের শাবক দেখতে পান ফরেস্ট বিভাগের এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিমের (ইআরটি) প্রধান সমন্বয়কারী মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি হাতির দলের সঙ্গে গোলাপি রঙের এই শাবকটির ভিডিও ধারণ করে তা পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিমকে পাঠান। পরবর্তীতে সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি সর্বমহলে আলোচিত হয়ে ওঠে।
জাহাঙ্গীর আলম জানান, বর্তমানে বরুনাছড়িতে পাঁচটি হাতিসহ একটি গ্রুপে নতুন এই গোলাপি হাতির শাবকটি রয়েছে। বয়স আনুমানিক দুই সপ্তাহ। সাধারণত বাচ্চা হাতির শরীরের লোম কালো হয়, কিন্তু এই শাবকটির ত্বক গোলাপি ও চুল অনেকটাই ফ্যাকাসে। বন বিভাগ বলছে, এটি সম্ভবত জিনগত মিউটেশন বা অ্যালবিনিজমের একটি দৃষ্টান্ত।
প্রকৃতির বার্তা
গোলাপি হাতি হলো প্রকৃতির এক সূক্ষ্ম বার্তা—প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। এই বিরল অস্তিত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি কতটা অপ্রত্যাশিত, কতটা বিস্ময়কর। তাই এদের রক্ষা করা শুধু পরিবেশ বা প্রাণিবিজ্ঞানের দায় নয়, এটি মানবিক দায়িত্বও বটে।
শেষ কথা:
গোলাপি হাতি নিয়ে গল্প, কিংবদন্তি কিংবা সাহিত্য থাকলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব একেবারে কল্পনাভিত্তিক নয়। প্রকৃতির এক বিচিত্র উপহার হিসেবে, এই হাতিগুলো আমাদের শেখায়, জিনগত ভিন্নতা কেবল বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের বিষয় নয়—এটি সৌন্দর্য, সম্মান ও বিস্ময়ের প্রতীকও হতে পারে।