নয়ন দাস, কুড়িগ্রাম: এক সময় বাংলার প্রতিটি গ্রামেই দেখা যেত কুঁড়েঘর। বাঁশ-কাঠের বেড়া, কাদামাটির দেয়াল, ছাউনি দেওয়া খড় বা টালির ছাদ এই ছিল বাংলার চিরায়ত গৃহসংস্কৃতি। সেসব ঘর ছিল শীতল, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম, এবং নির্মাণে ব্যয়ও ছিল কম। আজ সেই ঘরগুলো হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিক পাকা বাড়ির চাপে।
নগরায়নের ছোঁয়া এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও। টিনের চাল, সিমেন্ট-ইটের দেয়াল, মার্বেল-টাইলসের ঘর এখন যেন ‘উন্নতির’ প্রতীক। অথচ যেসব পরিবেশবান্ধব কুঁড়েঘর এক সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগেও টিকে থাকত, সেগুলো এখন অবহেলিত স্মৃতির অংশ মাত্র।
নাগেশ্বরী উপজেলার এক বৃদ্ধ কৃষক নূরুল আমিন বলেন, “আমার বাবা আর দাদা নিজের হাতে বাঁশ কেটে কুঁড়েঘর তুলেছিল। ৪০ বছর ছিল সেই ঘরে। এখন ছেলের পাকা বাড়ি হলেও, সেই মাটির ঘরের শীতলতা আর শান্তি পাই না।”
কুঁড়েঘর শুধু ঘর নয়, ছিল এক ধরণের জীবনের প্রতীক। বাঁশের কঞ্চিতে তৈরি জানালা দিয়ে ঢুকত বাতাস, দেয়ালের কাদামাটি শুষে নিত গরম, ছাউনি দেওয়া খড় বা টালির ছাদ ঠেকিয়ে দিত রোদ-বৃষ্টি। গ্রামের মহিলারা এসব ঘরের উঠানে বসে চাল ঝাড়তেন, বাচ্চারা খেলা করত, আর সন্ধ্যায় জ্বলে উঠত কুপি বাতি।
কিন্তু কুঁড়েঘর বানানো এখন কঠিন হয়ে উঠেছে। বাঁশের দাম বেড়েছে, দক্ষ মিস্ত্রি নেই, আর কেউ চায় না ‘মাটির ঘরে’ থাকতে। বরং সেই ঘরকে এখন ‘গরিবির প্রতীক’ মনে করা হয়। অথচ উন্নত বিশ্বে এখন পরিবেশবান্ধব ঘরের দিকে ঝুঁকছে মানুষ, বাংলার কুঁড়েঘরই যার অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারত।
অনেক বৃদ্ধ মানুষ বলেন, এখনকার বাড়িতে ঘুমাতে গেলেও ঘুম আসে না। ইট-পাথরের দেয়ালে প্রাকৃতিক শীতলতা নেই, বরং মেশিনে ঠাণ্ডা করতে হয়। অথচ তাদের সেই মাটির ঘর ছিল নিঃস্বার্থ আরামদায়ক।
শুধু টিকে থাকাটাই নয়, এই কুঁড়েঘরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির আবেগ, পারিবারিক বন্ধন, সংস্কার ও লোকাচার। ঘর তুলতে গ্রামের সবাই মিলে সহযোগিতা করত, প্রতিবেশীরা খেয়ে-দেয়ে সাহায্য করত, এবং তৈরি হতো এক ধরণের সামাজিক সংহতি। এখন এসব দৃশ্যও হারিয়ে গেছে।
আজ কুঁড়েঘর দেখা যায় কেবল কিছু লোকজ মেলায়, ফোক ফেস্টিভ্যালে, কিংবা টেলিভিশনের নাটকে। বাস্তব জীবনে তা যেন গল্পে রূপ নিয়েছে।
বাংলার হারিয়ে যাওয়া এই ঘর শুধু গৃহস্থের ঠিকানা ছিল না, ছিল হৃদয়ের আশ্রয়ও। সময় এসেছে এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ার যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে, কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে, সামান্য উপকরণে গড়ে উঠত একেকটি জীবনভর বেঁচে থাকার কাঠামো।