কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: সিমেন্ট শিল্পকে ঘিরে বৈশ্বিক উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের প্রশ্নে। কারণ, বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে এই খাতের অবদান প্রায় ৮ শতাংশ, যা এটিকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষণকারী খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই উচ্চ নিঃসরণের প্রধান দুটি কারণ হলো উচ্চ তাপমাত্রায় চুনাপাথর পোড়ানোর সময় ক্লিংকার উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক বিক্রিয়া, এবং প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সিমেন্ট শিল্পে পরিবেশবান্ধব রূপান্তরের ধারা
বিগত এক দশকে সিমেন্ট শিল্পে টেকসই উৎপাদনের ধারা জোরালো হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলো পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিকে গুরুত্ব দিয়ে ‘গ্রিন সিমেন্ট’ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এখানে মূলভাবে ক্লিংকারের ব্যবহার কমিয়ে আনা হচ্ছে, এবং তার পরিবর্তে ফ্লাই অ্যাশ (উড়ন্ত ছাই), গ্রাউন্ড গ্র্যানুলেটেড ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগ (জিএজিবিএস), ক্যালসাইন্ড ক্লে ইত্যাদি বিকল্প উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং পটেনশিয়াল (GWP) উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে এবং জ্বালানির খরচও কমছে।
আরেকটি বড় উদ্যোগ হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন ‘কার্বন সীম অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম’ (CBAM), যা রপ্তানিকারক দেশগুলোকে বাধ্য করছে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন মানদণ্ড পূরণ করতে। ফলে যারা ইউরোপে সিমেন্ট পণ্য রপ্তানি করতে চায়, তাদের জন্য কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানো এখন একটি বাধ্যতামূলক চাহিদা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা: এগোনোর পথ এখনও দীর্ঘ
বাংলাদেশে সিমেন্ট শিল্প গত তিন দশকে অভাবনীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশে সিমেন্ট কারখানাগুলোর সম্মিলিত বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৮ কোটিরও বেশি টনে পৌঁছেছে। তবে অধিকাংশ কারখানা এখনো উচ্চ ক্লিংকার নির্ভর, এবং কয়লা বা পেটকোকের মতো জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে।
তবে আশার কথা, কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। যেমন, দেশের একাধিক বড় ব্র্যান্ড ইতোমধ্যে ব্লেন্ডেড সিমেন্ট উৎপাদন শুরু করেছে, যেখানে ক্লিংকারের পরিবর্তে ফ্লাই অ্যাশ বা স্ল্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি বর্জ্যভিত্তিক বিকল্প জ্বালানি—যেমন RDF (Refuse Derived Fuel)—ব্যবহারের পরীক্ষামূলক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে কিছু কারখানায়। এর ফলে ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
নীতিগত সহায়তা ও প্রণোদনা: টেকসই পরিবর্তনের পূর্বশর্ত
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট উৎপাদন নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে এ খাতে আরও সক্রিয় হতে হবে। কর ছাড়, প্রযুক্তি আমদানিতে সহায়তা, গবেষণার জন্য বরাদ্দ এবং নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের ব্যবহার বাড়াতে নীতিগত উদ্যোগ জরুরি।
বিশেষত CBAM-এর প্রেক্ষাপটে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে সিমেন্ট খাতকে অবশ্যই নির্ধারিত কার্বন সীমা মেনে চলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ কার্বন হিসাব সংরক্ষণ পদ্ধতি, দূষণ নিরীক্ষণ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সুশৃঙ্খল প্রতিবেদন ব্যবস্থাপনা।
সামনে কী?
পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট উৎপাদন কেবল একটি প্রযুক্তিগত প্রয়োজন নয়, বরং জলবায়ু সংকটে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক দায়।
যদি বাংলাদেশ সময়মতো এই রূপান্তর নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে একদিকে দেশের সিমেন্ট শিল্প আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে নিজেকে আংশিকভাবে হলেও রক্ষা করতে পারবে। এই রূপান্তরের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শিল্প মালিক, নীতিনির্ধারক, গবেষক এবং পরিবেশকর্মীদের সম্মিলিত উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।