বিজনেসটুডে২৪ ডেস্ক: ওয়াসিম ও এজা-২০২২ সালে দুজনের পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রেম, আর বছর না ঘুরতেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। আপাতদৃষ্টিতে গল্পটা পাকিস্তানের হাজারো দম্পতির মতো মনে হতে পারে, যেখানে বিয়ের প্রক্রিয়াগুলো দ্রুত সম্পন্ন হয়। কিন্তু ওয়াসিম ও এজার গল্পটা কিছুটা ভিন্ন। তাঁদের পরিচয় ড্রয়িংরুমে চা খেতে খেতে কিংবা অফিসের কাছের কোনো কফি শপে হয়নি। তাঁদের গল্পটা শুরু হয়েছিল অনলাইনে—একটি ‘রিশতা’ বা ঘটকালি অ্যাপের মাধ্যমে।
পাকিস্তানে প্রায় এক দশক ধরে বিভিন্ন ধরনের ম্যাচমেকিং বা ডেটিং অ্যাপ চালু থাকলেও, রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় বিষয়টি নিয়ে খুব একটা খোলামেলা আলোচনা হয় না। নানা বিতর্ক আর নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে থাকা এই বিষয়টিকে স্বাভাবিক করতে চান ওয়াসিম ও এজা দম্পতি। তাঁরা কেবল নিজেদের পরিচয়ের মাধ্যম নিয়ে অকপটই নন, বরং অন্যদেরও জীবনসঙ্গী খুঁজতে এই পথ অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছেন।
ওয়াসিম বলেন, “আমরা আমাদের গল্পটা সবার সঙ্গে শেয়ার করছি, বিশেষ করে যারা জীবনসঙ্গী খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছেন বা হতাশ হয়ে পড়েছেন। যারা মনে করেন তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই, তাদের জন্যই আমাদের এই বার্তা।” তিনি আরও যোগ করেন, সাধারণত মানুষ আত্মীয়-স্বজন বা পেশাদার ঘটকদের (রিশতা আন্টি) দ্বারস্থ হন। কিন্তু অনেক সময় এসব ঘটক ভালো প্রস্তাবের পরিবর্তে অর্থের বিনিময়ে ‘প্যাকেজ’ অনুযায়ী পাত্র-পাত্রীর সন্ধান দেন।
রিশতা আন্টি বনাম অ্যাপ: নতুন প্রজন্মের পছন্দ
পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ’ বা পারিবারিকভাবে আয়োজিত বিয়ের সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে তরুণ প্রজন্ম ঝুঁকছে ডিজিটাল ম্যাচমেকিং অ্যাপের দিকে। ২০২৪ সালের গ্যালাপ ও গিলানি পাকিস্তানের এক জরিপ অনুযায়ী, এখনো দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ পারিবারিক বিয়ের পথই বেছে নেয়। তবে এই প্রথাগত প্রক্রিয়ায় তরুণ-তরুণীদের, বিশেষ করে নারীদের মতামত অনেক সময় উপেক্ষিত হয়। ঘটকদের দ্বারা বিচার-বিবেচনা, অদ্ভুত সব প্রশ্ন আর পারিবারিক চাপের মুখোমুখি হতে হয় তাদের।
এর বিপরীতে ‘মাজ’ বা ‘দিল কা রিশতা’র মতো অ্যাপগুলো নিজেদের কেবল বিয়ের জন্যই নিবেদিত বা ‘ম্যারেজ পারপাস ওনলি’ হিসেবে প্রচার করছে। এটি রক্ষণশীল পরিবারগুলোর কাছে অ্যাপগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সাহায্য করছে।
এজা বলেন, “অ্যাপে ছবি ঝাপসা করার সুযোগ থাকে, যা আমি ব্যবহার করেছিলাম। এখানে কেউ সরাসরি আপনার বাড়িতে এসে আপনাকে বিচার করছে না। যদি কাউকে পছন্দ না হয়, তবে কোনো মানসিক চাপ ছাড়াই তাকে না বলে দেওয়া যায়। ‘চালিয়ে দেখাও’, ‘একটু হাসো’ বা ‘বড় গাড়ি নেই কেন’—এমন সব অপমানজনক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না।”
নারীর ক্ষমতায়ন ও নিরাপত্তা
অ্যাপগুলো নারীদের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছে। ‘দিল কা রিশতা’ অ্যাপের সিইও মীর ইসহাক রেহমান জানান, অনেক নারী ছবি বা ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ্যে আনতে চান না। তাদের জন্য চালু করা হয়েছে ‘ভিআইপি ম্যাচমেকিং সার্ভিস’, যেখানে সরাসরি কনসালটেন্টদের মাধ্যমে গোপনীয়তা বজায় রেখে পাত্র খোঁজা হয়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক অ্যাপ ‘মাজ’-এর পাকিস্তানের মার্কেটিং প্রধান নায়াব নাজির বলেন, “আমরা রিশতা প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতাকারীদের সরিয়ে দিয়েছি। এটি একটি নির্ভরযোগ্য বন্ধুর মতো কাজ করে, যেখানে আপনি নিজের পছন্দমতো ফিল্টার ব্যবহার করে জীবনসঙ্গী খুঁজে নিতে পারেন।”
সারা, যিনি অ্যাপের মাধ্যমে তার স্বামীকে খুঁজে পেয়েছেন, তিনি বলেন, “প্রথাগত প্রক্রিয়ায় কাউকে আমাকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা কেন দেব? অ্যাপ আমাকে সেই নিয়ন্ত্রণ দিয়েছে।”
ডিজিটাল দুনিয়ার বিড়ম্বনা
তবে অ্যাপের দুনিয়াও পুরোপুরি নিখুঁত নয়। সারা ও আলিয়ার মতো ব্যবহারকারীদের মতে, অ্যাপে বিচিত্র সব মানুষের দেখা মেলে। কেউ কেউ প্রতারণার আশ্রয় নেন, কেউবা বিয়ের নাম করে অনৈতিক সম্পর্কের খোঁজ করেন। এছাড়া সাইবার বুলিং ও হয়রানির ঝুঁকি তো রয়েছেই।
মনোবিজ্ঞানী শিফা লোদি সতর্ক করে বলেন, “অনেকে অ্যাপে ঘোস্টিংয়ের (হঠাৎ যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া) শিকার হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। আবার অনেকে পারিবারিক চাপে অ্যাপের চেকলিস্ট মিলিয়ে তড়িঘড়ি বিয়ে করে পরে বিচ্ছেদের পথে হাঁটেন।”
সমাজ বদলাচ্ছে কি?
যদিও অ্যাপগুলো ঘটকালি প্রক্রিয়ায় নতুনত্ব এনেছে এবং নারীদের কিছুটা ক্ষমতায়ন করেছে, তবুও সমাজের গভীরে থাকা পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ও কুসংস্কার পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হয়নি। অ্যাপে এসেও অনেক পুরুষ যৌতুক বা উচ্চ বেতনের দাবি করেন। আলিয়ার মতে, “অ্যাপ হয়তো মাধ্যম বদলেছে, কিন্তু মানুষের মানসিকতা বা সমাজের মূল সমস্যাগুলো এখনো একই রয়ে গেছে।”
তবুও ওয়াসিম ও এজার মতো সফল দম্পতিরা আশার আলো দেখাচ্ছেন। তাদের মতে, বুঝেশুনে এবং সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো জীবনসঙ্গী খোঁজার ক্ষেত্রে একটি কার্যকরী ও স্বাধীন মাধ্যম হতে পারে। শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থেকেই যায়—সমস্যা কি অ্যাপে, নাকি আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে?
-সূত্র: ডন









