Home অন্যান্য শেরশাহ থেকে স্যাটেলাইট : চিঠির পাঁচশ বছরের যাত্রা

শেরশাহ থেকে স্যাটেলাইট : চিঠির পাঁচশ বছরের যাত্রা

ফিচার 

আমিরুল মোমেনিন:

যে বার্তা এক সময় পৌঁছাত রাজপথ পেরিয়ে ঘোড়ার খুরের শব্দে, সে বার্তা আজ পৌঁছায় নিঃশব্দে একটি মাউস ক্লিকে। বার্তার রূপ বদলেছে, বাহক বদলেছে, কিন্তু বার্তার প্রয়োজন আর মানুষের আকুলতা বদলায়নি।
শেরশাহের সময়ের বার্তা : ঘোড়ায় চড়ে আসা শব্দ

১৫৪০ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের বাইরে স্বাধীনভাবে ভারতের একটি বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণে নেন আফগান শাসক শেরশাহ সুরি। শাসনব্যবস্থায় দক্ষতা প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি যে সড়কব্যবস্থা ও ডাকব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তা আজও ইতিহাসে উদাহরণ হিসেবে উঠে আসে।

গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামের বিখ্যাত সড়ক তৈরি করেন তিনি, যা আধুনিক বাংলাদেশের কুমিল্লা থেকে শুরু হয়ে ভারতের কলকাতা, পাটনা, দিল্লি হয়ে চলে গেছে পেশোয়ার পর্যন্ত। এই সড়কের প্রতিটি কোসেই তৈরি হয়েছিল একটি সারাই। সেখানে থাকত নতুন ঘোড়া, বিশ্রাম, খাবার এবং বার্তাবাহক বদলের ব্যবস্থা।

শাসনব্যবস্থা সচল রাখতেই এই ডাক ব্যবস্থা চালু করা হলেও, ক্রমে এটি হয়ে ওঠে প্রশাসনিক এবং সামাজিক বার্তা আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম।

বৃটিশ আমলে চিঠির শাসন

ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশরা শেরশাহের গড়া কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে ডাক ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করে। ততদিনে আগত হয়েছিল ডাকপিয়ন। যাঁদের গলায় ঝুলত ব্যাজ বা ঘন্টা, হাতে থাকত কাপড়ের ব্যাগ। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে যেত খামের মধ্যে মোড়া খবর, ভালোবাসা, নির্দেশ বা অপেক্ষার ছায়া।

সেই সময় চিঠি মানে ছিল সম্পর্কের নিঃশব্দ নথিপত্র। কলেজ পড়ুয়া ছেলের খবর জানত বাবার কাছে। কেউ কাউকে জানাত তার পৃথিবীটা এখন কেমন নিঃসঙ্গ।

একুশ শতকের পালাবদল : ইমেইল ও তাৎক্ষণিকতা

এরপর এলো ইন্টারনেট। এলো ইলেকট্রনিক মেইল। প্রথমে কেবল সরকারি বা করপোরেট ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হলেও, দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের কাছে। আজ পত্রের জন্য কাগজ, কলম বা ডাকবাক্সের দরকার পড়ে না। প্রয়োজন শুধু একটি মোবাইল ফোন অথবা কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ।

এখন ঢাকায় বসে নিউ ইয়র্কে একটি ইমেইল পাঠানো যায় সেকেন্ডের মধ্যে। বার্তা যায় মুহূর্তে, ফেরত আসে প্রতিক্রিয়া। তবে এই দ্রুততা কি আবেগের গভীরতা কেড়ে নেয়নি?

হারিয়ে যাওয়া অনুভূতির খোঁজে

ইমেইলে আবেগ থাকে, কিন্তু চিঠির মতো অনুভব হয় না। সেখানে নেই মায়ের হাতের লেখা, নেই প্রিয়জনের ছুঁয়ে দেওয়া খাম, নেই অপেক্ষার শিহরণ। চিঠির পাণ্ডুলিপিতে যেমন ছিল কালি ছোপানো ভুল, অসমাপ্ত লাইন, তাতে ছিল ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি।

আজকের ইমেইল ত্বরিত, নিখুঁত, তথ্যসমৃদ্ধ। কিন্তু অনেক সময় নিঃসঙ্গও। তবে এমনটা বলাও ঠিক নয় যে যোগাযোগের আবেগ পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। আজও অনেকে সংবেদনশীল ইমেইল লেখে, আজও কেউ দুঃখের খবর জানায় টাইপ করা শব্দে। শুধু বদলেছে মাধ্যম, রয়ে গেছে মানুষের চাওয়া। কেউ একজন খবর রাখুক, শুনুক, ভালোবাসুক।

শেষ ভাবনা

পাঁচশ বছরের ব্যবধানে বার্তা আদান-প্রদানের রূপ নাটকীয়ভাবে বদলেছে। শেরশাহের ডাকঘর থেকে আজকের ইনবক্স, সবই প্রমাণ করে মানুষ তার অনুভব ভাগ করতে চায়। যন্ত্র যত আধুনিকই হোক না কেন, হৃদয়ের খবরটা এখনো মানুষই মানুষকে দেয়।