Home চট্টগ্রাম চট্টগ্রামে বিদ্রোহী নজরুল: বিক্ষোভের আগুন আর প্রকৃতির মমত্বে বাঁধা এক অধ্যায়

চট্টগ্রামে বিদ্রোহী নজরুল: বিক্ষোভের আগুন আর প্রকৃতির মমত্বে বাঁধা এক অধ্যায়


বিশেষ প্রতিবেদন:

চট্টগ্রাম: বাংলা সাহিত্যের দ্রোহ ও প্রেমের অনন্য কবি কাজী নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামের মাটিতে পা রেখেছিলেন এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে ১৯২৬ সালের আগস্ট মাসে। ভারত তখন ব্রিটিশ শাসনের গ্লানিতে ক্লান্ত, আর মানুষ মুক্তির স্বপ্নে জ্বলছিল বিদ্রোহের আগুনে। এমন সময় নজরুলের আগমন ছিল যেন জ্বলন্ত অনলের মাঝে আরেক প্রজ্জ্বলিত শিখা। চট্টগ্রাম সফরে এসে তিনি যেভাবে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেন, তা আজও গর্বের অধ্যায় হয়ে আছে এই বীর চট্টগ্রামের ইতিহাসে।

নজরুল এসেছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবক সৈয়দ মোহাম্মদ তাইয়বের আমন্ত্রণে। তিনি শহরের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অংশ নেন, বক্তব্য দেন, গান করেন এবং কবিতা আবৃত্তি করে তরুণদের মন জাগিয়ে তোলেন। তাঁর ভাষণ ছিল স্পষ্ট, দৃঢ় ও আগুন ঝরানো—যেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারিত হতো। চট্টগ্রামের তরুণদের চোখে তিনি দেখেছিলেন নিজস্ব প্রতিবিম্ব—বিদ্রোহ, প্রত্যয় আর আত্মমর্যাদার চেতনা।

তবে নজরুল শুধু রাজনৈতিক কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রকৃতি ও মানুষের কবিও। চট্টগ্রামের পাহাড়, সমুদ্র আর সবুজে ঘেরা নিসর্গ তাঁর হৃদয় ছুঁয়ে যায় গভীরভাবে। ১৯২৯ সালে সীতাকুণ্ডে অবস্থানকালে তিনি লেখেন এক অনন্যসাধারণ কবিতা “Rows of Betel Vines by My Window”। এতে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা, একাকীত্বের বিষাদ আর নীরব ভালোবাসা মিলে তৈরি করে এক আশ্চর্য আবেগময় গদ্যছন্দ, যা নজরুলের বিদ্রোহী ভাবনার বিপরীতে শান্ত ও সংবেদনশীল এক মাত্রা যোগ করে।

চট্টগ্রামের ডিসি হিল এলাকাও নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সেই সময় এই প্রাকৃতিক প্রাঙ্গণ ছিল কবির প্রিয় আশ্রয়স্থল, যেখানে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতেন কবিতা রচনায় ডুবে থেকে। তাঁর স্মৃতিকে অমর করে রাখতে ২০০৫ সালে এই স্থানটির নামকরণ করা হয় ‘নজরুল চত্বর’। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ সেই চত্বরের অনেক স্মৃতিচিহ্নই অবহেলা ও অযত্নে হারিয়ে যেতে বসেছে।

চট্টগ্রাম নজরুলকে শুধু আতিথ্যই দেয়নি, তাঁকে আত্মিকভাবে গ্রহণ করেছিল। আর নজরুলও এই নগরীর প্রকৃতি, মানুষের উষ্ণতা আর সংগ্রামী মানসিকতার মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন এক ধ্রুব আত্মীয়তা। তাঁর কবিতায় যেমন ঝড় ওঠে বিদ্রোহের, তেমনি চট্টগ্রামের প্রকৃতি তাঁকে দিয়েছিল এক গভীর প্রশান্তি।

আজ যখন আমরা নজরুলকে স্মরণ করি, তখন শুধু তাঁর সাহিত্য নয়, তাঁর চট্টগ্রাম-সংশ্লিষ্ট অধ্যায়টিকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। কারণ এই শহর নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা ও প্রকৃতি-নিমগ্ন হৃদয়ের বিরল সমন্বয়ের এক জীবন্ত প্রেক্ষাগৃহ।