ধারাবাহিক প্রতিবেদন: উত্তরের জীবনরেখা – কুড়িগ্রামকে জানুন কাছ থেকে
বিশেষ পর্ব:
উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি, রাজারহাট ( কুড়িগ্রাম) : রাজারহাট উপজেলার এক নিভৃত গ্রাম মন্ডলপাড়া। সেখানেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীপ্রাচীন চান্দামারী মসজিদ। তিনটি গম্বুজ আর মিহরাবসম্বলিত এ মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এক নীরব ঐতিহাসিক সাক্ষ্য। এখানে মোগল স্থাপত্যশৈলী ও সুলতানী আমলের কারুকার্য যুগপৎ দেখা যায়।
এ যেন এক প্রাচীন সৌন্দর্যের চিত্রপট, যা সময়ের ক্ষরণেও নিজের গাম্ভীর্য হারায়নি।
অবস্থান ও যাতায়াত
চান্দামারী মসজিদটি অবস্থিত কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার রাজারহাট ইউনিয়নের মন্ডলপাড়ায়।
রাজারহাট উপজেলা সদর থেকে সড়কপথে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পাড়ি দিলেই এই মসজিদটি চোখে পড়ে। পাকা সড়ক ও গ্রামীণ পথে কয়েক মিনিটের ভেতর যাওয়া যায়।
যাত্রীদের জন্য এটি কেবল ধর্মীয় স্থান নয়, বরং গ্রামীণ ঐতিহ্যের এক নান্দনিক গন্তব্যও বটে।
স্থাপত্যে ইতিহাসের ছাপ
মসজিদটি নির্মিত হয়েছে আনুমানিক ১৫৮৪ থেকে ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ-এর মধ্যবর্তী সময়ে—মোগল শাসনকালেই।
এর তিনটি গম্বুজ, তিনটি মিহরাব এবং মোটা দেওয়াল সুলতানী আমলের শক্তিশালী নির্মাণশৈলী ও মোগলীয় কারুকার্যের মেলবন্ধন তৈরি করেছে।
দেওয়ালে পোড়ামাটির অলঙ্করণ না থাকলেও এর বৃত্তাকার গম্বুজ, খিলানযুক্ত প্রবেশপথ, এবং অভ্যন্তরের গাম্ভীর্য স্থাপত্যরুচির এক নিদর্শন।
স্থানীয় প্রবীণ মো. ইয়াকুব আলী জানান, “আমার দাদার দাদাও এই মসজিদে নামাজ পড়েছেন। মসজিদটি শুধু ইবাদতের স্থান নয়, আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস বহন করে।”
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ঐতিহ্য
চান্দামারী মসজিদ কেবল স্থাপত্য নয়, বরং কুড়িগ্রাম অঞ্চলে ইসলামের বিস্তারের ইতিহাসেরও অংশ। ধারণা করা হয়, মোগল আমলে স্থানীয় জমিদার বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।
মসজিদটিকে ঘিরে ছিল মক্তব ও কবরস্থান। আজও কিছু পুরোনো কবর এই প্রাচীন ধর্মীয় কেন্দ্রের চারপাশে ছড়িয়ে আছে।
স্থানীয়দের মতে, এই স্থানটি একসময় আশপাশের কয়েক গ্রামের ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
সংরক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ
দুঃখজনকভাবে, এত বছরের পুরোনো এই নিদর্শনটির কোনো রাষ্ট্রীয় তালিকাভুক্তি বা বিশেষ সংরক্ষণ নেই। কিছুটা সংস্কার স্থানীয়ভাবে হয়েছে, কিন্তু মূল কাঠামো রক্ষায় নেই সরকারি উদ্যোগ।
গম্বুজে পানি পড়ে, কিছু অংশে ফাটল ধরেছে, প্রবেশপথের প্লাস্টার উঠে যাচ্ছে—এসবই এক নিঃশব্দ ধ্বংসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
স্থানীয় শিক্ষক শওকত হোসেন বলেন,
“মসজিদটি সংরক্ষণ করা গেলে এটি পর্যটন ও ইতিহাসচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হতে পারত।”
সম্ভাবনা: ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি
চান্দামারী মসজিদ শুধু কুড়িগ্রামের নয়, গোটা উত্তরাঞ্চলের এক গর্বের ইতিহাস। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্যায়ন এবং পর্যটন মানচিত্রে অন্তর্ভুক্তি ঘটাতে পারলে এই মসজিদ হয়ে উঠতে পারে জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ।
এখন প্রয়োজন সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ।
📢 এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কুড়িগ্রামের ঐতিহাসিক গৌরবের এক নিদর্শন। আপনিও চান কি মসজিদটি সংরক্ষিত হোক? লাইক দিন, শেয়ার করুন এবং কমেন্টে জানিয়ে দিন আপনার মতামত।