পর্ব–২
কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: ভোরের আলো ফুটতেই চা-বাগানে শুরু হয় এক নিঃশব্দ প্রস্তুতি। সূর্য ওঠার আগেই হাতে ঝুড়ি নিয়ে নারী-পুরুষ শ্রমিকেরা নামেন পাতাতোলায়। কিন্তু এ কাজ শুধুই পাতা তোলার নয়, এ যেন এক শিল্প। শুরু হয় বাগানের বুক ছুঁয়ে, শেষ হয় কাপের গভীর সুবাসে। সেই শিল্পের ভিত গড়ে ওঠে ওজনঘর আর কারখানার মধ্যে দিয়ে যেখানে একেকটি চায়ের ব্যাচ হয়ে ওঠে পরিশ্রম, অভিজ্ঞতা আর সময়ের সুনিপুণ মিশেল।
প্রথম গন্তব্য: ‘ওজনঘর’।
এটা শুধু একটি ঘর নয়, শ্রমিকদের নীরব প্রতিযোগিতা আর প্রত্যাশার জ্বালামুখ। প্রতিটি ঝুড়ি ভর্তি পাতা নিয়ে দাঁড়ান শ্রমিকেরা। একে একে এগিয়ে যান কাঁটা পাল্লার দিকে। ওজনদার নিখুঁত চোখে মেপে নেন প্রতিটি গ্রাম। খাতায় ওঠে সংখ্যার হিসাব, নাম, তারিখ আর সংগ্রহের পরিমাণ। নির্দিষ্ট ওজনের নিচে গেলে কমে যায় দিনমজুরি। অথচ কেউ মুখ খোলে না, শুধু চোখে ফুটে ওঠে চাপা উদ্বেগ।
তারপর শুরু হয় বাছাই। ‘দুই পাতা এক কুঁড়ি’ এই সোনার সূত্র মেনে চলে প্রথম ছাঁকনি। কিছু পাতা বাদ পড়ে, কিছু থেকে যায়। বাগানের ধারে নির্ধারিত কিছু জায়গায় বসে এই কাজ করেন দক্ষ শ্রমিকেরা। হাতে সময় কম। পাতা দীর্ঘক্ষণ সতেজ না থাকলে নষ্ট হওয়ার ভয়। তাই গতি আর নিখুঁত চোখ, দুটোরই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।
বাছাই শেষ হলে এগিয়ে চলে পাতা নিয়ে কারখানার পথে। চট্টগ্রামের বেশিরভাগ চা বাগানেই আছে নিজস্ব ‘চা প্রসেসিং ইউনিট’। কারখানার গেট পেরুতেই অনুভূত হয় এক ধরণের তীব্র সুবাস, যা বলে দেয় যে এখানে চলছে পাতার নবজন্ম।
প্রথম ধাপ ‘উইদারিং’ এ একপ্রকার প্রাকৃতিক শোধন। বিশাল ট্রেতে পাতাগুলো বিছিয়ে রাখা হয় বাতাসে, যাতে সরে যায় অতিরিক্ত আর্দ্রতা। এরপর সেই শুকনো পাতা ঢোকে রোলিং মেশিনে। লোহার চক্রের মধ্যে চাপা পড়ে পাতার রস, গন্ধ আর ভবিষ্যৎ স্বাদ।
এরপরই ‘গাঁজন’। একটি বিজ্ঞানসম্মত ধাপ, যেখানে তাপমাত্রা আর আর্দ্রতার নিখুঁত সমন্বয়ে পাতার মধ্যে তৈরি হয় কাঙ্ক্ষিত সুবাস। এই সময়ে সূক্ষ্মতম ভুলও হতে পারে মারাত্মক, নষ্ট করে দিতে পারে পুরো ব্যাচ। এরপর পাতাগুলো যায় ‘হট এয়ার ড্রায়ার’-এ। সেখানে নির্ধারিত সময় ধরে তাপ প্রয়োগে তৈরি হয় টেকসই চা।
শেষে ‘গ্রেডিং’।
চায়ের দানা, রং, গন্ধ সবকিছুর ভিত্তিতে করা হয় স্তরবিন্যাস। এখানে জন্ম নেয় পাতা চা, ব্রোকেন লিফ, ডাস্ট চা সবই একেক শ্রেণির কাহিনি। সবশেষে সেই চা পৌঁছায় ব্রোকারের নিজস্ব বন্ডেড ওয়্যারহাউসে। সেখানে প্যাকেটজাত হয়, চলে নমুনা সংগ্রহ। ক্যাটালগ তৈরি।
কিন্তু যা থাকে না দৃশ্যমান, তা হলো এই রূপান্তরের অন্তর্গত শ্রম।
একেকটি ব্যাচে লেগে থাকে অসংখ্য মানুষের নিঃশব্দ পরিশ্রম, যন্ত্রের আওয়াজ আর কাঁটা পাল্লার মাপজোক। চায়ের প্রতিটি কেজির মধ্যে লেগে থাকে ঘামের গন্ধ, যেটা কেবল বোঝা যায় তখনই, যখন কেউ চুমুক দেয় ভোরের এক কাপ চায়ে।