Home Third Lead জলবায়ু পরিবর্তনের থাবা: বিশ্বব্যাপী চা শিল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

জলবায়ু পরিবর্তনের থাবা: বিশ্বব্যাপী চা শিল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

হাস্যোজ্জ্বল মুখ, প্রাণবন্ত শৈশব, আসামের চা বাগানের কোলে বেড়ে ওঠা দুই কন্যা।

ঐতিহ্যবাহী অঞ্চলগুলো বিলুপ্তির মুখে

কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পানীয় চা, যা বর্তমানে ৫২ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমিতে চাষ হয় এবং কোটি মানুষের জীবিকার উৎস, সেটি এখন জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক হুমকির মুখে। সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, আগামী কয়েক দশকে বিশ্বের প্রধান চা উৎপাদন অঞ্চলগুলোর ভৌগোলিক চিত্র আমূল বদলে যেতে পারে, যা এই শিল্প এবং এর সাথে জড়িত কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

গবেষণার নেপথ্যে:
২০২৫ সালের মে মাসে ‘এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ইন্ডিকেটরস’ (Environmental and Sustainability Indicators) সাময়িকীতে প্রকাশিত এই যুগান্তকারী গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেছে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। উন্নত জলবায়ু মডেল এবং উচ্চ রেজোলিউশনের মানচিত্র ব্যবহার করে গবেষকরা ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির একটি বিস্তারিত ও উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছেন।

শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশগুলোর জন্য বিপদঘণ্টা:
গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মাঝারি থেকে উচ্চমাত্রার নির্গমন পরিস্থিতিতে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ ২০টি চা উৎপাদনকারী দেশের অর্ধেকের বেশি তাদের সর্বোত্তম চা উৎপাদন উপযোগী জমির বড় অংশ হারাতে পারে।

কেনিয়া: কালো চা রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান কেনিয়া, তাদের ২৬ শতাংশ পর্যন্ত উপযুক্ত চাষ এলাকা হারাতে পারে।

ভারত: ভারতের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল এবং ভৌগোলিকভাবে বৈচিত্র্যময়। কিছু অঞ্চলে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে চাষ উপযোগিতা কমে গেলেও, উঁচু পার্বত্য এলাকায় নতুন উপযোগী অঞ্চল গড়ে উঠতে পারে। গবেষকরা মনে করেন, ভারতের চা শিল্পে টেকসইতা বজায় রাখতে অঞ্চলভিত্তিক অভিযোজন কৌশল প্রয়োজন।

শ্রীলঙ্কা: ২০৫০ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কার উপযুক্ত চা চাষ এলাকা ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে, এবং ২০৭০ সালের মধ্যে তা ৩০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এটি দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে বড় আঘাত আনবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।

চীন: বিশ্বের সবচেয়ে বড় চা উৎপাদক দেশ চীনও এই হুমকির বাইরে নয়। দেশটির শীর্ষ চাষযোগ্য অঞ্চলে ৪.৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাসের আশঙ্কা রয়েছে, যা চায়ের গুণমান ও উৎপাদন উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা ও সমাধানের পথ:
ভারতের টকলাই টি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী ড. প্রদীপ বোরাহ এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু সহনশীল চা জাত উদ্ভাবন, উন্নত সেচ ব্যবস্থা এবং টেকসই কৃষি অনুশীলন জরুরি।”

কিছু দেশের জন্য সম্ভাবনার দ্বার:
তবে সব দেশই ক্ষতির মুখে পড়বে না। গবেষণায় দেখা গেছে, তুরস্কের জন্য একটি ইতিবাচক চিত্র রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে সেখানে চা চাষের জন্য উপযোগী ভূমি ১২৭ থেকে ১৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। একইভাবে ইরান, রুয়ান্ডা ও থাইল্যান্ডে উপযুক্ত চাষ এলাকা ১১ থেকে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা নতুন চা উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে এসব দেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

পরিবর্তনের মূল কারণ:
গবেষণায় ছয়টি পরিবেশগত উপাদানকে চা চাষের জন্য সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে: উষ্ণতম মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, শুষ্ক মৌসুমের গড় তাপমাত্রা, মাটির অম্লতা (pH), তাপমাত্রার বৈচিত্র্য, বর্ষাকালের গড় তাপমাত্রা এবং দিন-রাতের তাপমাত্রা পার্থক্য। এসব উপাদানের পরিবর্তনে চা গাছের বৃদ্ধি, গুণমান ও স্বাদে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে।

ক্ষুদ্র কৃষকদের ওপর প্রভাব ও অভিযোজন:
বিশ্বের মোট চা উৎপাদনের ৬০ শতাংশই আসে ক্ষুদ্র কৃষকের কাছ থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই শ্রেণির কৃষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গবেষকরা বলছেন, দ্রুত অভিযোজনই এখন একমাত্র পথ। এজন্য প্রয়োজন নতুন অবকাঠামো, গবেষণায় বিনিয়োগ, জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন, মাটির সংরক্ষণ এবং তথ্যভিত্তিক পরিকল্পনা।

ড. বোরাহের মতে, “জলবায়ু পরিবর্তন চা শিল্পের জন্য একদিকে বড় চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে সম্ভাবনাও। যেসব অঞ্চল নতুনভাবে উপযোগী হবে, তাদের কাজে লাগাতে হবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।”

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা স্পষ্ট, যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী চা উৎপাদন অঞ্চলগুলোর অনেকটাই আগামী এক প্রজন্মের মধ্যেই হারিয়ে যেতে পারে। এর পরিণতি শুধু কৃষকদের নয়, গোটা চা শিল্পের ভবিষ্যৎকেও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে।