Home বিশেষ প্রতিবেদন সাদা সোনার স্বপ্ন: চিংড়ি চাষে উজ্জ্বল গ্রামবাংলা

সাদা সোনার স্বপ্ন: চিংড়ি চাষে উজ্জ্বল গ্রামবাংলা

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, খুলনা: খুলনার পাইকগাছা উপজেলার একসময় মৎস্যজীবীদের হতাশা আর আর্থিক দৈন্য এখন ইতিহাস। পুকুরে আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে বদলে গেছে এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি। শুধু খুলনাই নয়, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালীসহ দেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলোতেও এ চাষ পদ্ধতি বিস্তৃত হচ্ছে দ্রুত গতিতে।

চিংড়ি চাষে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক ‘বায়োফ্লক’, ‘মাইক্রোবায়াল’ এবং ‘আর্টিফিশিয়াল ফিড’-নির্ভর পদ্ধতি। কৃষকরা বলছেন, আগের চেয়ে উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ, আর বাজারে দামও বেশ ভালো মিলছে।

স্থানীয় চাষি মো. ফারুক হোসেন জানান, “আগে যেখানে একরে ২৫০–৩০০ কেজি গলদা চিংড়ি হতো, এখন আধুনিক পদ্ধতিতে হচ্ছে ৫০০–৬০০ কেজি পর্যন্ত। খরচ কিছুটা বেশি হলেও লাভ অনেক বেশি।”

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শুধু খুলনা অঞ্চলে ২৮ হাজার টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি।

ছবি সংগৃহীত

বিশেষজ্ঞদের মতে, রপ্তানিযোগ্য এই ‘সাদা সোনা’ চাষে টেকসই পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণের অভাবেই অনেক কৃষক পূর্বে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। বর্তমানে সরকার ও বিভিন্ন এনজিওর প্রশিক্ষণ এবং সহজ ঋণ সুবিধার ফলে ছোট চাষিরাও সাহস পাচ্ছেন।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রাশেদা ইয়াসমিন বলেন, “আমরা চাষিদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করলে রোগবালাই কম হয়, এবং উৎপাদনও হয় মানসম্পন্ন।”

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পুকুর-ভিত্তিক চিংড়ি চাষ শুধু রপ্তানি আয়ে অবদান রাখছে না, বরং কর্মসংস্থান, নারীর অংশগ্রহণ এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল করে তুলছে।

বাংলাদেশে চিংড়ি চাষ আরও সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রাখে যদি জলবায়ু ঝুঁকি, পানির মান এবং পোকামাকড় প্রতিরোধ ব্যবস্থায় আরও উদ্ভাবন আনা যায়। চাষিরা চাইছেন সরকারি সহযোগিতা আরও জোরদার হোক।

বাংলাদেশে চিংড়ি চাষ বহু বছর ধরেই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক খাত হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে গলদা এবং বাগদা চিংড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় এ খাতটি ‘সাদা সোনা’র উপাধি পেয়েছে। তবে এই খাতকে টেকসই করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকের দিকে নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

আধুনিক চাষপদ্ধতিতে উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই, তবে উন্নত ফিড, পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা এবং ওষুধের খরচও বেড়েছে। অনেকে আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতনের শঙ্কায় বিনিয়োগে পিছিয়ে যাচ্ছেন।

পানি লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড় এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত চিংড়ি চাষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উপকূলীয় অঞ্চলে টেকসই খামার ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু-সহনশীল প্রজাতি উন্নয়নে গবেষণা অপরিহার্য।

চিংড়ি রপ্তানিতে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজার বাংলাদেশের অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে HACCP ও ISO সার্টিফায়েড চাষ পদ্ধতির প্রসার জরুরি।

চিংড়ি চাষে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, বিশেষ করে প্রসেসিং ও খামার ব্যবস্থাপনায়। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত যুবসমাজকেও এই খাতে সম্পৃক্ত করা গেলে দেশে কর্মসংস্থান বাড়বে।

চাষিদের জন্য সহজশর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগে সরকারি পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক। তবে রপ্তানি ও খামার ব্যবস্থাপনায় আরও প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন প্রয়োজন।

চিংড়ি খাত শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকে নয়, জাতীয় রপ্তানিও শক্তিশালী করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব এবং পরিকল্পিত খামার ব্যবস্থাপনার বিস্তার।