Home Second Lead হংকং কনভেনশনের পর চট্টগ্রামের জাহাজভাঙ্গা শিল্প: রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে

হংকং কনভেনশনের পর চট্টগ্রামের জাহাজভাঙ্গা শিল্প: রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে

ছবি এ আই
বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম উপকূল বিশ্বের বৃহত্তম জাহাজভাঙ্গা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড সৈকতে প্রথমবারের মতো জাহাজভাঙ্গা শুরু হয়। তারপর থেকে চার দশকের বেশি সময়ে চট্টগ্রাম ধীরে ধীরে ‘বিশ্বের শিপব্রেকিং রাজধানী’তে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি পুরোনো জাহাজ এখানে ভাঙা হয়। কিন্তু ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া হংকং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য সেফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টালি সাউন্ড রিসাইক্লিং অফ শিপস এ শিল্পে আমূল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব

চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্টিল ইন্ডাস্ট্রির জন্য কাঁচামালের প্রধান উৎস। দেশে গড়পড়তা প্রায় ৭০–৮০ শতাংশ স্টিল রড ও রিবারের চাহিদা পূরণ হয় ভাঙা জাহাজ থেকে পাওয়া স্ক্র্যাপ মেটাল দিয়ে। বছরে প্রায় ২৫–৩০ লাখ টন লোহা এই শিল্প থেকে আসে। এছাড়া, ব্যবহৃত জেনারেটর, মেশিনারিজ, কাঠ, আসবাবপত্র থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা জিনিসও স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয়। ফলে চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

হংকং কনভেনশনের শর্ত

নতুন কনভেনশনে জাহাজভাঙ্গার সময় পরিবেশ দূষণ কমানো, বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কড়া নিয়ম মানতে হবে। যেমন—

  • অ্যাসবেস্টস, পিসিবি (PCB), পারদসহ ক্ষতিকর উপকরণ আলাদা করে নিরাপদে নিষ্পত্তি করতে হবে।
  • শ্রমিকদের জন্য হেলমেট, মাস্ক, গ্লাভসসহ সম্পূর্ণ সুরক্ষা সরঞ্জাম বাধ্যতামূলক।
  • তেল, রাসায়নিক পদার্থ ও গ্যাস ট্যাঙ্ক নিরাপদে পরিষ্কার করে তারপর জাহাজ কাটতে হবে।
  • সমুদ্র সৈকতে সরাসরি জাহাজ টেনে এনে ভাঙার প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে ইয়ার্ডভিত্তিক কনক্রিট ফ্লোর ও ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে।
চট্টগ্রামের প্রস্তুতি

বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (BSBRA) তথ্যমতে, চট্টগ্রামে সক্রিয় প্রায় ১০০টির বেশি ইয়ার্ডের মধ্যে এখন মাত্র ২৫–৩০টি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। কয়েকটি ইয়ার্ড ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমোদন পেয়েছে, যেগুলো থেকে ইউরোপীয় শিপিং কোম্পানিগুলো তাদের পুরোনো জাহাজ পাঠাতে পারবে।

তবে ছোট ও মাঝারি ইয়ার্ডগুলো এখনও বড় চ্যালেঞ্জে আছে। তারা বলছে, নতুন মানদণ্ডে বিনিয়োগ করতে গেলে কয়েক কোটি টাকা থেকে শত কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ হবে, যা সবার পক্ষে সম্ভব নয়।

শ্রমিকদের বাস্তবতা

চট্টগ্রামের শিপব্রেকিং শিল্পে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রায় দুই লাখ শ্রমিক কাজ করেন। বহু বছর ধরে এই শ্রমিকরা দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণ এবং বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকিতে ছিলেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে সমালোচনা করেছে।

হংকং কনভেনশন কার্যকর হওয়ার পর শ্রমিকদের জন্য বড় আশা হলো—তাদের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। তবে শ্রমিকদের একাংশের মধ্যে শঙ্কাও আছে: যদি অনেক ছোট ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে।

পরিবেশগত প্রভাব

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলে জাহাজভাঙ্গা শিল্পের কারণে সমুদ্র দূষণ, মাটি ও পানি দূষণ এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশবাদীরা সতর্ক করে আসছে। অনেক সময় ভারী ধাতু, তেল ও রাসায়নিক পদার্থ সমুদ্রে মিশে যায়, যার প্রভাব স্থানীয় জেলেদের জীবন-জীবিকায়ও পড়ে। নতুন কনভেনশন কার্যকর হলে এ সমস্যা অনেকাংশে সমাধান হতে পারে, তবে শর্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি

শিপইয়ার্ড মালিকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মান মেনে চললে শুরুতে খরচ বাড়লেও দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে। এতে বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলো স্বচ্ছন্দে বাংলাদেশে জাহাজ পাঠাবে, যা শিল্পকে আরও টেকসই করবে। তবে তারা সরকারের কাছ থেকে সহজ ঋণ, কর রেয়াত এবং অবকাঠামোগত সহায়তা চাইছেন।

ভবিষ্যৎ চিত্র

বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে একটি Ship Recycling Act পাস করেছে এবং চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক মানের শিপ রিসাইক্লিং ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরও মনিটরিং বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সরকার ও উদ্যোক্তারা যৌথভাবে কাজ করে, তবে বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বৈশ্বিক পর্যায়েও পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙ্গার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

তবে এটি নির্ভর করবে—

  • ছোট ইয়ার্ডগুলো কতটা মানিয়ে নিতে পারে,
  • শ্রমিকদের নিরাপত্তা কতটা বাস্তবায়িত হয়,
  • আন্তর্জাতিক শিপমালিকরা কতটা আস্থা রাখেন।

যদি এগুলো ইতিবাচকভাবে সমাধান হয়, তবে হংকং কনভেনশন বাংলাদেশের জন্য বাধা নয়, বরং সুযোগ হয়ে দাঁড়াতে পারে।