কামরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূল, যেখানে বিশাল বিশাল ধূসর ধাতব কাঠামো শুয়ে আছে বালুচরে। এ যেন এক বিশাল কবরখানা, কিন্তু এখানে মৃত্যু নয়, বরং নতুন জীবনের সূচনা ঘটে। পুরনো হয়ে পড়া জাহাজগুলো বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এসে এখানে শেষ ঠিকানায় পৌঁছায়। এই পুরো প্রক্রিয়া যাকে বলা হয় শিপ ব্রেকিং, শুরু হয় “বিচিং” নামক একটি নীরব কিন্তু নাটকীয় ধাপে।
বিচিং: বিশাল জাহাজের উপকূলে উঠে আসা:
পুরনো হয়ে যাওয়া জাহাজগুলো প্রথমে কেনা হয় আন্তর্জাতিক নিলামের মাধ্যমে। এরপর এগুলো ভাসিয়ে আনা হয় চট্টগ্রাম বন্দরের পাশের সীতাকুণ্ড উপকূলে। উপকূলীয় এলাকা বালুময় এবং ঢালু হওয়ার কারণে এখানে জাহাজকে সরাসরি উপকূলে উঠিয়ে আনা সম্ভব। এই কাজটিই হচ্ছে বিচিং।

সাধারণত ভাটা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে জোয়ারের সর্বোচ্চ সময় ব্যবহার করে জাহাজটিকে চালানো হয় উপকূলের দিকে। নিয়ন্ত্রিত গতিতে, বিশেষ কৌশলে চালানো হয় যেন জাহাজটি নির্দিষ্ট স্থানে উঠে গিয়ে আটকে যায়। এরপর সেটি থেকে সব ইঞ্জিন তেল, রাসায়নিক ও গ্যাস সরিয়ে ফেলা হয়-এই অংশটিই সবচেয়ে বিপজ্জনক।
নিরাপত্তা ও বিষাক্ত পদার্থ সরানোর প্রক্রিয়া:
জাহাজে থাকা অ্যাসবেস্টস, ভারী ধাতব উপাদান, জ্বালানী তেল ও অন্যান্য রাসায়নিক অপসারণ করা হয়। এই কাজ করতে হয় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের দিয়ে, কারণ সামান্য অসতর্কতায় হতে পারে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা বা পরিবেশ দূষণ।
বিশেষত পুরনো জাহাজে অ্যাসবেস্টস ও পিসিবির মতো বিষাক্ত উপাদান থাকে যা সরানোর জন্য প্রয়োজন হয় পিপিই, মাস্ক এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যদিও এসব সুরক্ষা সবসময় কার্যকর থাকে না, শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকি নিয়েই এসব কাজ করতে হয়।
কাটার কাজ শুরু: কুচি কুচি ধাতব স্বপ্নভঙ্গ:
সব ধরণের দূষণ ও বিপজ্জনক বস্তু অপসারণের পর শুরু হয় কাটা। এক এক করে খুলে ফেলা হয় জাহাজের বহিরাবরণ। গ্যাস কাটার দিয়ে খণ্ড খণ্ড করা হয় বিশাল স্টিলের পাত। ধ্বংসযজ্ঞের মাঝেও এখানে চলে নিখুঁত কৌশল, কোথা থেকে শুরু করতে হবে, কোন অংশ আগে সরাতে হবে, কীভাবে ভারসাম্য রাখতে হবে।

প্রথমে কাটা হয় ডেক ও সুপারস্ট্রাকচার, এরপর ধাপে ধাপে মূল কাঠামো। শ্রমিকেরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আগুনের ফুলঝুরির মতো গ্যাস কাটার দিয়ে জাহাজের শরীর খণ্ডিত করে। রাতভর চলে এই কাজ, সমুদ্রের গর্জনের সঙ্গে মিশে থাকে ধাতব শব্দ।
পুনঃব্যবহার: ধ্বংস নয়, পুনর্জন্ম:
কাটা অংশগুলো ট্রাকযোগে চলে যায় রোলিং মিল, রি-রোলিং প্ল্যান্ট কিংবা পুনর্ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশের দোকানে। লোহার পাত গলে গিয়ে হয় রড, বিম, এঙ্গেল, যন্ত্রাংশ বা শিল্প খুঁটি। এমনকি অনেক সময় জাহাজের আসবাবপত্র, জানালা-দরজা, মোটর, এমনকি রেফ্রিজারেটর পর্যন্ত আলাদা করে বিক্রি করা হয়।
একটি বড় জাহাজ ভেঙে শেষ হতে সময় লাগে ৩ থেকে ৬ মাস, কখনো কখনো এক বছর। এই সময়ের মধ্যে শত শত শ্রমিক কাজ করে, যাদের বেশিরভাগই আসে দেশের উত্তরাঞ্চল বা উপকূলবর্তী দরিদ্র অঞ্চল থেকে।
মানবিক দিক: জীবন ঝুঁকির বিনিময়ে জীবিকা:
এই শিল্পে শ্রমিকদের ঝুঁকি অনেক। নিরাপত্তার অভাব, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, দীর্ঘ সময় ধরে ভারী কাজ এবং গ্যাস কাটার ব্যবহার—সব মিলিয়ে এটি একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক পেশা। তবু জীবিকার তাগিদে হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এই ইয়ার্ডে ঢুকে পড়ে। কারও মুখে ঝুঁকির কথা নেই তারা জানে, এই লোহা কাটতেই তাদের পেট চলে।
পুরনো জাহাজের বিচিং থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে কাটা এবং পুনর্ব্যবহার-এই প্রক্রিয়া একদিকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উৎস, অন্যদিকে শ্রমিক ও পরিবেশের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ। নিয়ন্ত্রিত ও মানবিক পদ্ধতিতে এই শিল্প পরিচালনা করা গেলে বাংলাদেশের জন্য এটি হতে পারে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও শিল্পজাত লোহা সরবরাহের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।