মাহবুবুল হক, মাস্কাট ( ওমান ): সাগরের ঢেউয়ে ভেসে চলেছে জীবন। অথচ এ সাগর আরব সাগর হলেও, ভাষা, চালচলন, খাবার আর মুখের ভাষায় মনে হবে যেন বাংলাদেশেরই কোনো উপকূলীয় শহর। এমনটাই মনে হবে ওমানের দক্ষিণাঞ্চলের সাগরপাড়ের শহর সালালায়। দশ হাজার কিলোমিটারের ব্যবধানে হলেও, এখানকার অলিগলিতে বাংলা ভাষার প্রতিধ্বনি শোনা যায়, চায়ের দোকানে ধোঁয়া ওঠা রুটি-সবজির পাশে বসে আড্ডা চলে ঠিক বাংলাদেশের মতো। সালালা যেন এক ‘মিনি বাংলাদেশ’।
সালালায় বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নির্মাণশিল্প, কৃষিখামার, মাছ ধরা, এবং গৃহস্থালি কাজ থেকে শুরু করে ছোট ব্যবসা পর্যন্ত বাংলাদেশিরা আজ সালালার অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছেন। স্থানীয়রা এক নামে চিনে “বাংলাদেশি মানে পরিশ্রমী, বিশ্বাসযোগ্য”। এমন সুনাম সহজে আসে না—তা অর্জন করতে হয়েছে বছর দশেক ধরে রক্ত-ঘামে গড়া অধ্যবসায়ে।
শহরের হাফা বাজার, সাইলা নর্থ এলাকা, সাদাহ জেলার কিছু অংশে গেলে চোখে পড়বে একের পর এক বাংলা দোকান, হোটেল, সেলুন ও মুদি দোকান। এখানে ‘চট্টগ্রাম হোটেল’, ‘ঢাকা বিরিয়ানি হাউজ’ কিংবা ‘সিলেট স্টোর’ এমন সব নামধারী দোকানে ক্রেতারা যেমন বাংলাদেশি, তেমনি খাবারের স্বাদও একেবারে দেশের মতো। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড, প্রবাসীদের হাতে হাতে স্মার্টফোনে দেশের গান কিংবা নাটকের ভিডিও—এই সবকিছু মিলিয়ে সালালা হয়ে উঠেছে আরেক টুকরো বাংলাদেশ।
সালালার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ওমানের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানকার আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে শীতল, বিশেষত খারিফ মৌসুমে যখন সবুজে ঢেকে যায় পাহাড়, তখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের মনে পড়ে যায় সিলেট বা রাঙামাটির দৃশ্য। ছুটির দিনে বাংলাদেশিরা দল বেঁধে বেড়িয়ে পড়েন পাহাড়ি এলাকায়, মাছ ধরেন, বারবিকিউ করেন—আর সেসব মুহূর্ত সামাজিক মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেন স্বজনদের সঙ্গে।
সালালায় বসবাসকারী চট্টগ্রামের মো. সাইফুল ইসলাম জানান, “আমি এখানে আছি প্রায় ১২ বছর। এখন মনে হয়, এটাই আমার দ্বিতীয় বাড়ি। পাশে থাকা ভাইরাও প্রায় সবাই বাংলাদেশি, কাজের ক্ষেত্রেও দেশি ভাইয়েরাই বেশি, তাই কখনো একাকীত্ব লাগে না।” তিনি আরও বলেন, “সালালার মানুষেরা আমাদের শ্রদ্ধা করে, ধর্মচর্চার স্বাধীনতা আছে, এমনকি ঈদে আমরা নিজের মতো অনুষ্ঠানও করি।”
তবে এই আরামদায়ক চিত্রের আড়ালে লুকিয়ে আছে কঠোর বাস্তবতাও। অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক এখনো মাসের পর মাস বেতন পান না, অসুস্থ হলেও সঠিক চিকিৎসা পান না। বাসস্থানের সমস্যাও রয়েছে কিছু এলাকায়। তবুও স্বপ্ন দেখে তারা—একদিন দেশে ফিরে একটি ঘর বানাবেন, সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়বেন। আর এই স্বপ্ন নিয়েই প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে তাদের।
সালালা এখন আর শুধু বিদেশের মাটি নয় এ যেন দেশ থেকে দূরে আরেকটা বাংলাদেশ, যেখানে শ্রম, কষ্ট আর ভালোবাসার ফসলে গড়ে উঠছে প্রবাসীদের নতুন পৃথিবী।