মওলানা মোহাম্মদ কাউসার: সপ্তাহের সাতটি দিনের মধ্যে শুক্রবার বা জুমার দিন মুসলিমদের জন্য এক বিশেষ তাৎপর্য ও অসীম ফজিলত নিয়ে আসে। এটি কেবল একটি সাধারণ দিন নয়, বরং এটি সাপ্তাহিক ঈদ, আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অনন্য সুযোগ এবং ইবাদতের জন্য এক পবিত্র মুহূর্ত। এই দিনের সম্মানে পবিত্র কোরআনে ‘আল-জুমা’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা নাজিল হয়েছে, যা এর গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সপ্তাহের সেরা দিন এবং এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জুমার দিনকে সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর বর্ণনায় ফুটে উঠেছে এই দিনের মহিমা। তিনি বলেছেন, সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিনই সর্বোত্তম। এই দিনে মানবজাতির পিতা আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল, এই দিনেই তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিল এবং জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল। এমনকি মহাপ্রলয় বা কিয়ামতও এই শুক্রবারে সংঘটিত হবে। তাই এই দিনটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে পরিপূর্ণ।
ঐতিহাসিকভাবেও এই দিনের গুরুত্ব অপরিসীম। বদরের এক সাহাবীর বর্ণনা অনুযায়ী, রাসূল (সা.) বলেছেন যে জুমার দিনটি সমস্ত দিনের সর্দার এবং আল্লাহর কাছে ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের চেয়েও মহান। এর পাঁচটি বিশেষ দিক হলো—আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, পৃথিবীতে আগমন, তাঁর ওফাত, দোয়া কবুলের বিশেষ মুহূর্ত এবং কিয়ামত সংঘটিত হওয়া।
ক্ষমা ও প্রার্থনা কবুলের দিন
জুমার দিন মুমিনদের জন্য গুনাহ মাফ ও দোয়া কবুলের এক সুবর্ণ সুযোগ। নবীজি (সা.) শিখিয়েছেন যে, এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত মাঝের দিনগুলোর ছোট ছোট গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যদি ব্যক্তি কবিরা গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখে।
এই দিনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এতে এমন একটি বিশেষ মুহূর্ত রয়েছে, যখন কোনো মুসলিম বান্দা আল্লাহর কাছে যা-ই প্রার্থনা করে, আল্লাহ তা কবুল করে নেন—যদি না তা কোনো হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয় হয়। এই সময়টুকু আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য এক অমূল্য উপহার।
জুমার দিনের করণীয় ও আমল
এই বরকতময় দিনের পূর্ণ সওয়াব ও কল্যাণ লাভ করার জন্য কিছু বিশেষ আমল রয়েছে, যা পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
পরিচ্ছন্নতা ও প্রস্তুতি: জুমার দিনে গোসল করাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। উত্তমরূপে গোসল করে, সাধ্যমতো ভালো ও পরিষ্কার পোশাক পরিধান করে, সুগন্ধি মেখে মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া এই দিনের অন্যতম সুন্নত।
দ্রুত মসজিদে গমন: জুমার নামাজের জন্য আগেভাগে মসজিদে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে বিরাট সওয়াব। ফেরেশতারা মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন এবং আগমনকারীদের নাম পর্যায়ক্রমে লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। যে সবার আগে আসে, সে যেন একটি উট কোরবানির সওয়াব লাভ করে। এরপর পর্যায়ক্রমে গরু, মুরগি ও ডিম সদকা করার সমতুল্য সওয়াব লেখা হয়। খুতবা শুরু হয়ে গেলে ফেরেশতারা সেই খাতা বন্ধ করে খুতবা শুনতে মশগুল হয়ে পড়েন।
মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা: জুমার খুতবা শোনা ওয়াজিব। খুতবা চলাকালে কথা বলা বা অন্য কোনো কাজে মনোযোগ দেওয়া সম্পূর্ণ অনুচিত। যে ব্যক্তি মনোযোগ সহকারে খুতবা শোনে, আল্লাহ তার এক জুমা থেকে আরেক জুমা এবং অতিরিক্ত আরও তিন দিনের গুনাহ ক্ষমা করে দেন।
সুরা কাহাফ পাঠ: জুমার দিনে সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করার ফজিলত অপরিসীম। যে ব্যক্তি এই দিনে সুরা কাহাফ পাঠ করে, আল্লাহ তার জন্য দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়কে নূর বা আলো দ্বারা আলোকিত করে রাখেন।
অধিক দরুদ পাঠ: এই দিনে প্রিয় নবী (সা.)-এর ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমরা জুমার দিনে আমার ওপর অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করো, কারণ তোমাদের সেই দরুদ আমার কাছে পেশ করা হয়।”
ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ: জুমার নামাজের আজান হওয়ার পর থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের দুনিয়াবি কাজ, বিশেষ করে কেনাবেচা বন্ধ রাখা ঈমানের পরিচায়ক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, “হে ঈমানদারগণ! যখন জুমার দিনে নামাজের জন্য আহ্বান করা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং কেনাবেচা ত্যাগ করো।”
বস্তুত, জুমার দিন শুধু একটি সাপ্তাহিক নামাজ আদায়ের দিন নয়; এটি আমাদের আত্মিক পরিশুদ্ধি, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং পরকালের পাথেয় অর্জনের দিন। তাই আমাদের সকলের উচিত এই দিনের গুরুত্ব অনুধাবন করে এর প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানো।