আজহার মুনিম, লন্ডন: ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী হাই স্ট্রিটের একের পর এক দোকান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অথচ ঠিক তখনই উল্টো পথ ধরেছে ট্যাটু পার্লারগুলো। গত এক দশকে দেশটিতে ট্যাটু ব্যবসা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০১৩ সালে যেখানে ট্যাটু পার্লারের সংখ্যা ছিল ১,৬৩৭, ২০২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৩,৩৯৪-এ। আর বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ ব্রিটিশ নাগরিকের শরীরে কমপক্ষে একটি ট্যাটু রয়েছে—যা প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যের ট্যাটু শিল্পের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৭০২ মিলিয়ন পাউন্ডে, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। মনোবিজ্ঞানী ও আচরণগত আসক্তিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. মার্ক গ্রিফিথস জানাচ্ছেন, “অধিকাংশ মানুষ ট্যাটু করিয়ে ইতিবাচক মনোভাব অনুভব করেন। কেউ কেউ হতাশা বা উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতেও এটি ব্যবহার করেন।”
ড. গ্রিফিথস আরও বলেন, “ট্যাটু একজন মানুষকে নিজের শরীরের প্রতি ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে পারে, আত্মবিশ্বাস বাড়াতে পারে, এমনকি এটি কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের অংশ বলেও মনে করায়। অনেক ক্ষেত্রে এটি অতীতের মানসিক ট্রমা, যৌন নিপীড়ন বা পিটিএসডি-র বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবেও কাজ করে।”
থেরাপির মতোই শক্তিশালী ট্যাটু
ডার্বি শহরের খ্যাতিমান ট্যাটু শিল্পী কেভিন পল, যিনি এড শিরান, হ্যারি স্টাইলস, লেডি গাগা ও রিহানার মতো তারকাদের শরীরে কালি দিয়েছেন, জানান, “ট্যাটু এখন অনেকের কাছে একধরনের থেরাপি হয়ে উঠেছে। কেউ ভালোবাসার মানুষের স্মৃতি ধরে রাখতে, কেউবা জীবনের কঠিন অধ্যায়ের স্মারক হিসেবে ট্যাটু বেছে নিচ্ছেন।”
তিনি জানান, অনেকেই আত্মক্ষতের দাগ ঢাকতে ট্যাটু করিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন। “একজন মেয়ে এসেছিলেন, যিনি বহুদিন আত্মহানিমূলক কাজে লিপ্ত ছিলেন। তার দাগগুলো আমি ঢেকে দিই ট্যাটু দিয়ে। সে বলেছিল, এ যেন তাকে আবার বাঁচিয়ে তুলেছে,” বলেন কেভিন।
তবে আছে ঝুঁকিও
ট্যাটু শিল্পে যেমন ইতিবাচক দিক আছে, তেমনি আছে কিছু ভয়ানক বাস্তবতাও। অপেশাদার ও অ-লাইসেন্সধারী “স্ক্র্যাচার” নামের ট্যাটু কারিগরেরা নিয়মবহির্ভূতভাবে কাজ করছেন, যার ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। কেভিন পল বলেন, “অনেকেই খরচ কমানোর জন্য যাচ্ছেন অপেশাদারদের কাছে, যার ফলে মানহীন ও বিপজ্জনক ট্যাটু হচ্ছে।”
গবেষণা বলছে, ৪০ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক কোনো না কোনো সময় তাদের ট্যাটু মুছে ফেলার কথা ভেবেছেন—কারও ডিজাইন ভালো না লাগায়, কারও পুরনো হয়ে যাওয়ায়, আবার কেউ হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলে।
ট্যাটু: জীবনের গল্পের প্রতিচ্ছবি
লিঙ্কনশায়ারের ২৯ বছর বয়সী মা চেসনি রাইট তার শরীরে ২০০টির বেশি ট্যাটু করিয়েছেন, যার পেছনে খরচ করেছেন ৪ হাজার পাউন্ডের বেশি। “আমার ট্যাটুগুলো আমার জীবনের গল্প—ভালোবাসা, দুঃখ, মা হওয়ার আনন্দ, সবই এখানে আছে। কেউ দেখে কটূক্তি করে, কিন্তু আমি গর্বিত,” বলেন চেসনি।
এদিকে ৩৫ বছর বয়সী আনা উলি নিজের আত্মঘাতী প্রবণতা ও মাদকাসক্তি থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ট্যাটুর সাহায্যে। তিনি জানান, নিজের হাতে থাকা ক্ষতের দাগ ঢেকে দিয়ে একরকম নতুন জীবন পেয়েছেন। এখন তিনি নিজেই পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মনোবিশেষজ্ঞ আলেকসান্দ্রা প্যামফ্লেট বলেন, “ট্যাটু অনেক সময় মানসিক যন্ত্রণা থেকে উত্তরণের একটি পন্থা হতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি আবার পুরনো স্মৃতির ট্রিগার হিসেবেও কাজ করতে পারে।”
👉 আরও প্রতিবেদন পেতে চোখ রাখুন: www.businesstoday24.com