বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) কর্তৃক মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পর বৈশ্বিক শিপিং জায়ান্ট সিএমএ সিজিএম আগামী ২৬ অক্টোবর ২০২৫ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে সমস্ত আমদানি ও রপ্তানি চালানের উপর জরুরি ব্যয় পুনরুদ্ধার সারচার্জ (ECRS) আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। সিপিএ-এর নতুন মাশুল কাঠামো ১৫ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে, যা চার দশকেরও বেশি সময় পর প্রথম বড় ধরনের মাশুল সংশোধন। সিএমএ সিজিএম একটি গ্রাহক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সিপিএ-এর মাশুল বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় পরিচালনা ব্যয়ের প্রভাব প্রশমিত করার উদ্দেশ্যেই এই সারচার্জ।
সিএমএ সিজিএম-এর সারচার্জ এবং বিস্তারিত:
ফরাসি শিপিং লাইন সিএমএ সিজিএম জানিয়েছে যে, ইসিআরএস চট্টগ্রাম বন্দরে (BDCGP) পরিচালিত সকল চালানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, চুক্তি বা চালান শর্ত নির্বিশেষে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ইসিআরএস-এর হার কন্টেইনারের ধরন ও কার্গো বিভাগ অনুযায়ী ৪৫ ডলার থেকে ৩০৫ ডলার পর্যন্ত হবে। শুষ্ক কন্টেইনারের জন্য ২০-ফুট ইউনিটে ৪৫ ডলার এবং ৪০-ফুট ইউনিটে ৭০ ডলার চার্জ করা হবে। রেফ্রিজারেটেড কন্টেইনারের জন্য ৪০-৯০ ডলার, আউট-অফ-গেজ কার্গোর জন্য ১১০-২৪৫ ডলার এবং বিপজ্জনক কার্গোর জন্য ১৪০-৩০৫ ডলার দিতে হবে। পেমেন্ট স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হবে, যা চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের বার্থিং তারিখের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে।
ব্যবসায়ীদের সমন্বয় সভা
মাশুল বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে, দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পপতি এবং আসন্ন চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই) নির্বাচনে “ওয়ান টিম”-এর প্যানেল লিডার মোহাম্মদ আমিরুল হকসহ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতারা সমন্বয় সভা আহ্বান করেছেন। ১২ অক্টোবর, রবিবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রামের র্যাডিসন ব্লু হোটেলের মোহনা-৩, লেভেল-৪ এ অনুষ্ঠিত হবে। আশা করা হচ্ছে যে, এই বৈঠকে মূল বাণিজ্য ও শিল্প সংস্থার নেতারা একত্রিত হয়ে মাশুল বৃদ্ধির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবেন, সম্ভাব্য প্রতিকার অন্বেষণ করবেন এবং সরকারের কাছে একটি যৌথ প্রস্তাব পেশ করার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন করবেন। সভার আমন্ত্রণপত্রে আমিরুল হক লিখেছেন: “আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে আমরা কার্যকরভাবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করতে পারব এবং এই সংকটের একটি টেকসই সমাধান খুঁজে পাব। আমাদের ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি”।
সিপিএ-এর মাশুল বৃদ্ধির কারণ ও বিতর্ক:
সিপিএ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, নতুন হার কলম্বো এবং সিঙ্গাপুরের মাশুলের কাছাকাছি আনার লক্ষ্যে নির্ধারিত হয়েছে। তবে, ব্যবসায়িক মহল ও রপ্তানিকারকরা সতর্ক করেছেন যে, এই ফি বৃদ্ধি বাংলাদেশের বাণিজ্য নেটওয়ার্কে লজিস্টিক খরচ বাড়িয়ে দেবে, যা ইতিমধ্যেই শক্তিশালী ডলার এবং উচ্চ জ্বালানি মূল্যের কারণে চাপের মধ্যে রয়েছে।
এএনএফ’র তথ্যমতে, সিপিএ-এর মাশুল বৃদ্ধি এমন সময়ে এলো যখন বন্দরের ডলার-ভিত্তিক হার ১৯৮৬ সাল থেকে অপরিবর্তিত ছিল। ১৯৮৬ সালে এক ডলারের বিপরীতে ২৭ টাকা পাওয়া গেলেও, বর্তমানে তা প্রায় ১২২ টাকা। ফলে, মাশুল সংশোধন ছাড়াই সিপিএ-এর টাকা আয় চারগুণ বেড়েছে। এমনকি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বন্দরটি ২,৯১৩ কোটি টাকা রেকর্ড মুনাফা করেছে। এমন লাভজনক পরিস্থিতিতে মাশুল বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ব্যবসায়ীরা।
আইএফসি-এর ভূমিকা ও স্বার্থের সংঘাত:
সিপিএ-এর নতুন মাশুল কাঠামোর সঙ্গে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতের অঙ্গ ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্স কর্পোরেশন (আইএফসি)-এর সুপারিশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সরকারের লেনদেন উপদেষ্টা হিসেবে আইএফসি পতেঙ্গা ও লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনালের জন্য ছাড় চুক্তি ডিজাইন করতে সহায়তা করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম বন্দরকে বেসরকারি, বিশেষ করে বিদেশি অপারেটরদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা। সমালোচকরা অভিযোগ করেছেন যে, এই মাশুল সংশোধনী বিদেশি অপারেটরদের বেশি সুবিধা দেবে।
আইএফসি-এর দ্বৈত ভূমিকা—নীতি উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশের বন্দর প্রকল্পে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী—স্বার্থের সংঘাতের ধারণা তৈরি করেছে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন। বিশ্বব্যাংকের বোর্ড বে টার্মিনাল প্রকল্পের জন্য ৬৫ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে, এবং আইএফসি বেসরকারি খাতের নেতৃত্বাধীন টার্মিনালগুলোর একটিতে বিনিয়োগের কথা বিবেচনা করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদি আইএফসি এই টার্মিনালগুলোতে বিনিয়োগ করে, তাহলে এটি এমন একটি প্রকল্পের বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেবে যা থেকে তারা লাভবান হতে পারে, যা নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে।
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ ও প্রতিবাদ:
চিটাগাং চেম্বারের সাবেক এক পরিচালক বলেন, “বন্দর যখন ফি বাড়ায়, তখন ক্যারিয়াররা তাদের মুনাফা রক্ষা করতে চার্জ সমন্বয় করে। শেষ পর্যন্ত, আমদানিকারক, রপ্তানিকারক এবং ভোক্তারা এর প্রভাব বহন করেন”। শিল্প সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন যে, সিএমএ সিজিএম-এর সারচার্জ অন্যান্য বৈশ্বিক লাইন যেমন মার্স্ক, এমএসসি এবং হ্যাপি-লয়েডকেও একই ধরনের ব্যবস্থা নিতে উৎসাহিত করতে পারে, যা বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে কন্টেইনারাইজড বাণিজ্যের খরচ আরও বাড়িয়ে দেবে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই) সহ বাণিজ্য সংস্থাগুলো সরকারের কাছে মাশুল বৃদ্ধির সময় পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে। তারা সতর্ক করেছে যে, অতিরিক্ত সারচার্জ বৈশ্বিক চাহিদা কমার প্রেক্ষাপটে রপ্তানি প্রতিযোগিতা দুর্বল করতে পারে। সিসিসিআই-এর সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, “আমরা বারবার সতর্ক করেছি যে, বন্দর চার্জে হঠাৎ ৪১% বৃদ্ধি সাধারণ ভোক্তাদের উপর কঠিন আঘাত হানবে”। তিনি আরও উল্লেখ করেন, “মুদ্রাস্ফীতি ইতিমধ্যেই ৮.৫% এ রয়েছে, এবং এই পদক্ষেপ এটিকে আরও বাড়িয়ে দেবে”।
ব্যবসায়ীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে তারা নতুন মাশুল বৃদ্ধির আগেও উচ্চ হারে মাশুল প্রদান করছিল। ২০২০ সালে যখন বিনিময় হার ছিল প্রতি ডলারে ৮৫ টাকা, তখন ৪৩ ডলারে একটি টিইইউ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং খরচ ছিল ৩,৬৫৫ টাকা। ২০২৪ সাল নাগাদ, ডলারের মূল্য ১২৪ টাকা হওয়ায়, একই ৪৩ ডলারের চার্জ বেড়ে ৫,৩৩২২ টাকা হয়েছে — মাত্র চার বছরে ১,৬৭৭ টাকা বা ৪৫% বৃদ্ধি।
উচ্চতর খরচ এবং ভোক্তাদের উপর প্রভাব:
ব্যবসা নেতারা বলেছেন যে, নতুন মাশুল বিদেশি অপারেটরদের রাজস্ব বাড়ালেও, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ব্যবসার উচ্চতর খরচের সাথে সংগ্রাম করবে — এই খরচ শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের উপর চাপানো হবে, যারা ইতিমধ্যেই মুদ্রাস্ফীতির বোঝা বহন করছেন। র্যাপিডের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, সিপিএ একবারে ৪০% বৃদ্ধি না করে ধাপে ধাপে মাশুল বাড়াতে পারত। ধাপে ধাপে বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের উপর খরচের বোঝা কমাত এবং তাদের সমন্বয় করার জন্য সময় দিত।
চট্টগ্রাম শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ শিপিং মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে একটি চিঠিতে নতুন মাশুল কাঠামো পর্যালোচনার জন্য আবেদন করেছেন।