বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে ট্যারিফ বৃদ্ধির ঘোষণা নিয়ে ব্যবসায়িক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৫ অক্টোবর থেকে প্রায় ৪১ শতাংশ বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে বন্দরের সেবা পেতে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হবে।
এর প্রভাব ইতিমধ্যেই দেশের শিপিং খাতে পড়তে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি সিএমএ-সিজিএম ২৬ অক্টোবর থেকে কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, অন্যান্য কোম্পানিও একই পথে পা বাড়াবে, ফলে আমদানি-রপ্তানিতে খরচ বাড়বে এবং ব্যবসায়িক ব্যয় ও পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে।
রোববার (১২ অক্টোবর) দুপুরে চট্টগ্রামের হোটেল র্যাডিসন ব্লুতে সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের সমন্বিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তারা বলেন, বন্দরের মাশুল ৪১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ালে সরাসরি আমদানি-রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা না করে ট্যারিফ বৃদ্ধিকে ব্যবসায়িক নীতির পরিপন্থী হিসেবে অভিহিত করেন।

সভায় সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, “বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণ, কিন্তু এখন সেটিকে ঘিরে ‘খেলা’ শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতামত উপেক্ষা করে ট্যারিফ বাড়ানো অনৈতিক এবং আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বন্দরে চেম্বারের একজন প্রতিনিধিকে পরিচালক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হবে।”
চেম্বারের সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, “আমরা কারও গোলাম নই। ব্যবসায়ীদের অর্থেই বন্দর চলে। কোনো আলোচনা ছাড়াই ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধি ষড়যন্ত্রমূলক। দেশের অন্যান্য বন্দর যেমন মোংলা বা পায়রায় এমন বৃদ্ধি করা হয়নি।”আমি ৪০ বছর ব্যবসা করছি। কচি খোকা নই। বন্দর বাঁচাতে হবে। বন্দরকে কস্ট বেইজড ট্যারিফ করতে হবে। আমরা কি গোলাম? কলুর বলদ? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেন ট্যারিফ বাড়াবে? আর কোনো টাকা বন্দরের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না। এনসিটির পর একটি পতেঙ্গা টার্মিনাল হয়েছিল, সেটি দিয়ে দিয়েছেন!
স্বাগত বক্তব্যে এশিয়ান গ্রুপের শীর্ষ নির্বাহি এমএ সালাম বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। বন্দর ব্যবসা করে না, সেবা দেয়। মাশুল এক মাসের জন্য পিছিয়েছে, আমরা চাই না বন্দর লস করুক। ট্যারিফ বৃদ্ধি হলে আমরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব।”
বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি সেলিম রহমান জানান, বাংলাদেশের পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিযোগিতার মুখে রয়েছে। “ভিয়েতনাম, ভারত ও মালয়েশিয়ার তুলনায় আমাদের খরচ ইতিমধ্যেই বেশি। ট্যারিফ বৃদ্ধি হলে রপ্তানি খরচ আরও বাড়বে এবং ক্রেতারা বিকল্প বাজারে চলে যেতে পারেন।”
মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহসভাপতি এ এম মাহবুব চৌধুরী বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর জনগণের টাকায় প্রতিষ্ঠিত। এটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান; তাই অযৌক্তিকভাবে মাশুল বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। বন্দরের নীতিনির্ধারণে ব্যবসায়ীদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে।”
বেপজিয়ার সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভির বলেন, “বন্দর খরচ বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা হারাবে। আমরা এখনও আমদানিনির্ভর দেশ, তাই এ ব্যয় পুরো সাপ্লাই চেইনে প্রভাব ফেলবে।”
বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিপিং এজেন্ট ফি বাড়াবে। ভিয়েতনামের তিনগুণ খরচ হবে চট্টগ্রাম বন্দরে। আজকের দিনে ব্যবসায়ীদের পক্ষে কথা বলার কোনো সংগঠন নেই। ব্যবসায়ী সমাজ বিচ্ছিন্ন, হতাশাগ্রস্ত। সরকারি আমলারা এখন চট্টগ্রাম চেম্বার চালাচ্ছেন। দেশের অর্থনীতি, রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ীদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, “নদীনির্ভর বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের সক্ষমতা সীমিত। আমরা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু ৪১ শতাংশ বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত ব্যয় বেড়েছে। ২০ ফুট কনটেইনারে ১২-১৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত গুনতে হবে।”
বারভিডার হাবিবুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ ড. ইউনূস। তাঁর কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। লাভে থাকার পরও কেন চট্টগ্রাম বন্দর ট্যারিফ বাড়াচ্ছে। চিটাগং চেম্বারে নির্বাাচিত নেতৃত্ব নেই বলে ব্যবসায়ীদের নানা সংকট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। তারা ব্যাংকঋণ পাচ্ছে না। ট্যারিফ দিচ্ছি ডলারে। ৮০ টাকার ডলার এখন ১২২ টাকা। এখানেই তো ট্যারিফ বেড়ে গেছে। কাউকে লাভ করানোর জন্য অর্থনীতি ধ্বংস করা যাবে না। প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টি বিবেচনা করবেন আশাকরি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর গত অর্থবছরে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। লাভজনক অবস্থায় থাকলেও ট্যারিফ বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন ট্যারিফ নির্ধারণ করা হোক, যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেশের অর্থনীতি উভয়ই সুরক্ষিত থাকে।
সভা শেষে ব্যবসায়ীরা সর্বসম্মতভাবে দাবি জানান—স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা না হওয়া পর্যন্ত বর্ধিত ট্যারিফ কার্যকর করা যাবে না। তারা বলেন, “বন্দর টিকলে দেশ টিকবে। তাই ব্যবসাবান্ধব ও প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে হবে।”