Home First Lead ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রতিবাদে ব্যবসায়ীদের আল্টিমেটাম: বন্দর অচল করার হুমকি

ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রতিবাদে ব্যবসায়ীদের আল্টিমেটাম: বন্দর অচল করার হুমকি

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে ক্ষোভে ফুঁসছে ব্যবসায়ী মহল। দেশের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই বন্দরকে ঘিরে নেওয়া নতুন চার্জ কাঠামোকে তারা বলছেন “অযৌক্তিক, একতরফা এবং অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।” শনিবার (১৮ অক্টোবর) নেভি কনভেনশন হলে চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজারস ফোরাম আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় বক্তারা এই ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

প্রতিবাদ সভায় সভাপতির বক্তৃতায় কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন চট্টগ্রাম পোর্ট ইউজারস ফোরাম-এর কনভেনর চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী।

তিনি বলেন, “যদি সরকারের পক্ষ থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে ট্যারিফ বৃদ্ধি প্রত্যাহার বা যৌক্তিক সমাধান না আসে, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হবে।” এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “ট্যারিফ ৪১ শতাংশ বাড়ানোর পর আমরা পোর্ট ইউজার্স ফোরামের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। সেখানে দুটি দাবি ছিল—এই সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত করা এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে যৌক্তিক ট্যারিফ নির্ধারণ করা। কিন্তু এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।”

তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা বর্তমানে সনদ স্বাক্ষর নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বিষয়টিতে মনোযোগ দিতে পারেননি বলে আনঅফিসিয়ালি জানানো হয়েছে। “তাই আজকের এই সভা মূলত স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য—এখনই যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, ব্যবসায়ীরা আর অপেক্ষা করবে না,” বলেন তিনি।

সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এসময় আমির হুমায়ুন মাহমুদ ঘোষণা দেন, “সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন আগামীকাল রবিবার থেকে চার ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করবে। আরও দুটি সংগঠনও একইভাবে কর্মবিরতিতে যাবে। পাশাপাশি আমরা আবারও সরকারকে স্মারকলিপি দেবো।”

তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, “এটা শুধু চট্টগ্রামের বিষয় নয়, পুরো বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও জনগণের বিষয়। এই বাড়তি টাকার বোঝা শেষ পর্যন্ত জনগণের পকেট থেকেই যাবে। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।”

প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা জানি উনি সংবেদনশীল ও বিচক্ষণ একজন মানুষ। আশা করি, তিনি দ্রুত হস্তক্ষেপ করে এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের সমাধান করবেন।”

সভা শেষে উপস্থিত ব্যবসায়ীরা প্রস্তাবিত কর্মসূচির প্রতি হাত তুলে সমর্থন জানান

সভায় স্বাগত বক্তব্যে বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি, শিল্পপতি এমএ সালাম বলেন, “ব্যবসায়ীরাই দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। দেশের ৮৫ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয়। অথচ বন্দরের নতুন ট্যারিফে ব্যবসায়ীরা এখন নিজেদের অনিরাপদ মনে করছেন।”
তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর কোনো লোকসানি প্রতিষ্ঠান নয়—বরং প্রতি বছর আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকা লাভ করছে। তাহলে কেন এই কারসাজি? ট্রেইলার ধর্মঘট শুরু হয়ে গেছে, এতে কনটেইনার চলাচল ব্যাহত হবে। স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে ট্যারিফ শিডিউল পুনর্নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছি।”

চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী নেতা মোহাম্মদ আমিরুল হক। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময় নেওয়া হয়েছে, যখন এফবিসিসিআই কিংবা চিটাগাং চেম্বার সক্রিয় নেই। তাই সুবিধামতো সময় বেছে নিয়েই এই অন্যায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। কিন্তু আমরা এটা হতে দেবো না—দেবো না, দেবো না।”

বিদেশি অপারেটরদের বিপক্ষে নয় জানিয়ে আমিরুল হক বলেন, “আমরা বিদেশি অপারেটরের বিরুদ্ধে নই, কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বাড়িয়ে তাদের সুবিধা করে দেওয়া হবে না। যদি ট্যারিফ বাড়াতে হয়, তবে সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে বসে আলোচনা করে যৌক্তিক সমাধান বের করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “যখন ডলারের দাম ছিল ৩০ টাকা, তখনকার ট্যারিফের সঙ্গে এখনকার ১২২ টাকার ডলার দরে তুলনা করা উচিত। যুগের পরিবর্তনে ট্যারিফ পুনর্নির্ধারণ দরকার, কিন্তু সেটা যুক্তির ভিত্তিতে হতে হবে।”

বিজিএমইএ পরিচালক এমডিএম মহিউদ্দিন বলেন, “বন্দরে ট্যারিফ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড ঘটে গেছে। বাড়িভাড়া বা দোকানভাড়ারও নীতিমালা আছে, কিন্তু বন্দরে যেভাবে ইচ্ছেমতো চার্জ বাড়ানো হয়েছে, তা অগ্রহণযোগ্য। প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসায়ী সমাজ, পরে সাধারণ মানুষও মার খাবে। আমেরিকার ট্যারিফ নিয়েই আমরা বিপাকে, এর মধ্যে বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধি কাম্য নয়।”

শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের  নজরুল ইসলাম বলেন, “বন্দর কিছু ক্ষেত্রে ৪৪০ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ বাড়িয়েছে। পোর্ট লিমিট বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে চার্জও বাড়ানো হয়েছে—এটা অস্বাভাবিক। পাইলটিং, পোর্ট ডিউজ—সব জায়গায় খরচ বেড়ে গেছে। ট্যারিফ নির্ধারণ কস্ট-বেইজড হওয়া উচিত। না হলে শিপ ওনাররা চার্জ বাড়াবে, শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্র অচল হয়ে পড়বে।”
তিনি যোগ করেন, “আমাদের শেষ ভরসা এখন প্রফেসর ইউনূসের ওপর। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করেই ট্যারিফ নির্ধারণ করতে হবে।”

সভা পরিচালনা করেন এসএম আবু তৈয়ব। তিনি বলেন, “যে সরকার আমেরিকায় গিয়ে ট্যারিফ কমানোর অনুরোধ করে, সেই সরকার নিজ দেশে ট্যারিফ বাড়াচ্ছে। এতে ব্যবসায়ী সমাজ উদ্বিগ্ন। এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, এবং ইতিমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টাকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।”

বাফা’র পরিচালক অমিয় শঙ্কর বর্মণ বলেন, “বন্দর ও অফডক একসঙ্গে ট্যারিফ বাড়িয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত। এটা অসহনীয়।”

বিজিএমইএ নেতা শহীদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “দেশে এখন লুটপাট চলছে। ২০ ফুট কনটেইনার লোড-আনলোডে ৬০ ডলার খরচ হচ্ছে। সরকারি পর্যায়ের পাশাপাশি বেসরকারি ক্ষেত্রেও লুটপাট বেড়ে গেছে।”

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, “ব্যবসায়ীদের জন্য এটা দুসংবাদ—মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। বিদেশে ট্যারিফ কমাতে সরকার সফল হয়েছে, কিন্তু দেশে ট্যারিফ বাড়িয়ে অর্থনীতির লাইফ লাইন—চট্টগ্রাম বন্দরের অস্তিত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।” তিনি আরও বলেন, “১২ টাকার ফি করা হয়েছে ১১৫ টাকা। ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন আর পিছু হটার সুযোগ নেই—প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”

 সাইফুল আলম বলেন, “আমাদের ১৩ হাজার শ্রমিক কর্মচারী আল্টিমেটাম দিয়েছেন যে তারা কাজ করতে আগ্রহী নয়। এই খরচের বোঝা নিয়ে তারা কাজ করতে পারছেন না।” তিনি আরও বলেন, আগামী রোববার (আগামীকাল) এর মধ্যে সরকারকে এই বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে।

কর্মসূচি ও আল্টিমেটাম:
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নলিখিত কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়:

৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি: ১৯ অক্টোবর রবিবার থেকে সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-সহ আরও দুটি সংগঠন ৪ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করবে।

স্মারকলিপি পেশ: সরকারের কাছে অবিলম্বে আরেকটি স্মারকলিপি দেওয়া হবে, যেখানে শুল্ক বৃদ্ধির প্রতিবাদে উত্থাপিত সকল দাবি জানানো হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর অচল করার হুমকি: যদি এক সপ্তাহের মধ্যে শুল্ক বৃদ্ধির এই সমস্যার সমাধান না করা হয়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হবে।