মোজাফফর রাহমান বাদল, কুষ্টিয়া: কখনও কি গভীর রাতে গ্রামে ঢেঁকির “ঢুং ঢাং” শব্দে ঘুম ভাঙার অভিজ্ঞতা হয়েছে আপনার? যারা এই শব্দ শুনে বড় হয়েছেন, তারা জানেন এ কেবল ধান ভানার শব্দ নয়, এ ছিল বাংলার এক অনন্য ছন্দ। এক সময় প্রতিটি গৃহস্থ বাড়িতে ঢেঁকির উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। আর এখন? আধুনিক মিলের যান্ত্রিক শব্দে হারিয়ে যাচ্ছে সেই মানবিক ধ্বনি।
ধান কেটে ঘরে আনার পর ঢেঁকিতে চাল বানানোর প্রস্তুতি চলত দিনের পর দিন। বাঁশ দিয়ে তৈরি ঢেঁকি, এক পাশে ভার দিয়ে ধান ভাঙা হতো পায়ের চাপে। সাধারণত নারীরাই এই কাজ করতেন। একেক বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে দুই-তিনজন মিলে ঢেঁকি চালাতেন, সঙ্গে চলত হাসি, গান, গল্প। আর সেই শব্দ ছড়িয়ে পড়ত আশপাশে, ঘুম ভাঙত শিশুর, উঠত পাখির।
চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ৭৫ বছর বয়সী আম্বিয়া খাতুন বলেন, “বউ হয়ে যখন এ বাড়ি আসি, তখন প্রতিদিন ভোরে উঠেই ঢেঁকি চালাতে হতো। এখন আমার নাতিনেরা জানেই না ঢেঁকি কী জিনিস।”
ঢেঁকির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নারীর পরিশ্রম, পারিবারিক ঐক্য আর কৌমসংস্কৃতি। কিন্তু মিল কল আসার পর থেকে তা কেবল অকেজো বস্তু হয়ে উঠেছে। চালকলের স্বচ্ছ চালের আকর্ষণ, কম খরচ ও সময়সাশ্রয় এই ঐতিহ্যকে হারিয়ে দিলেও, হারিয়েছে আরও অনেক কিছু—মানুষের পরস্পরের সংযোগ, কাজের সম্মিলন, কণ্ঠে কণ্ঠে ঢেঁকিগান।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢেঁকিতে ভানা চালে পুষ্টিগুণ কিছুটা বেশি থাকত, কারণ এতে চালের ত্বক পুরোপুরি উঠে যেত না। কিন্তু মিলের চকচকে চাল শুধুমাত্র দেখতেই আকর্ষণীয়, পুষ্টির দিক থেকে নয়। অথচ সেই চিরচেনা ঢেঁকি এখন পাওয়া যায় কেবল জাদুঘরে, লোকজ মেলায় বা কোনও প্রাচীন সিনেমায়।
শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রসার যেমন অপরিহার্য, তেমনি নিজস্ব ঐতিহ্যও ধরে রাখা জরুরি। অনেক দেশে ঐতিহ্যিক কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতিকে ‘ইন্ট্যানজিবল হেরিটেজ’ বা অদৃশ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আমাদের ঢেঁকিও তেমনই এক মূল্যবান নিদর্শন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শত শত নারীর ঘাম, ঘর, ও গান।
আজ যখন কোনো পুরনো বাড়ির উঠানে পড়ে থাকা একটি ভাঙা ঢেঁকি চোখে পড়ে, তখন মনে পড়ে যায় সেই শব্দ, সেই ছন্দ,যা এখন আর শোনা যায় না। ঢেঁকি হারিয়ে গেলে কেবল একটি যন্ত্র হারায় না, হারায় এক টুকরো গ্রামীণ জীবন।