Home Second Lead জীবনের প্রথম একা ফ্লাইটেই থেমে গেল পাইলট তৌকিরের আকাশযাত্রা

জীবনের প্রথম একা ফ্লাইটেই থেমে গেল পাইলট তৌকিরের আকাশযাত্রা

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, ঢাকা: সোমবার সকালে সবার মতোই একটি নতুন দিনের সূচনা হয়েছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের জন্য। কিন্তু সেই দিনই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক ফ্লাইট—সলো ফ্লাইট। বিমানবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী এটি ছিল চূড়ান্ত পরীক্ষার শেষ ধাপ, একা জেট চালিয়ে সফলভাবে ফিরে আসার অভিযান।

তৌকির ঠিকই উড়লেন। নিখুঁতভাবে উড্ডয়ন করেন, আকাশে ওড়েন আত্মবিশ্বাস নিয়ে। কিন্তু ফিরে এলেন না। তার বিমান বিধ্বস্ত হয়। দেশের মেধাবী এক তরুণ, স্বপ্নবান এক সৈনিক—চিরতরে নিথর হয়ে গেল আকাশেই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আকাশের পথে: মেধাবীর পথচলা

তৌকির ইসলামের গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট এলাকায়। তবে পরিবারটি দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীর উপশহরের সপুরা এলাকায় ‘আশ্রয়’ নামের একটি বহুতল ভবনের ভাড়া ফ্ল্যাটে বসবাস করে আসছে।

তৌকিরের বাবা তহুরুল ইসলাম, মা সালেহা খাতুন, বড় বোন সৃষ্টি ও বোনজামাই রাজশাহীতেই আছেন। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। রাজশাহীর ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তিনি ভর্তি হন পাবনা ক্যাডেট কলেজে—যেখান থেকে শুরু হয় তার শৃঙ্খলার, স্বপ্নের এবং সাহসিকতার যাত্রা।

শুধু পাইলট নয়, একজন সদ্য বিবাহিত স্বামীও ছিলেন তিনি

এক বছর আগে বিয়ে হয় তৌকির ইসলামের। স্ত্রীর নাম আকশা আহম্মেদ নিঝুম, তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা। বিয়ের ছয় মাস পর, গত ফেব্রুয়ারিতে নববধূকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘরে তোলেন তৌকির। এরপর এই নবদম্পতি থাকতেন ঢাকায় বিমানবাহিনীর কোয়ার্টারে।
তাদের বৈবাহিক জীবনের সময়টা খুব অল্প হলেও ছিল শান্তিময়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ভরা। কিন্তু সেই সব স্বপ্ন আজ থমকে গেছে। স্ত্রী নিঝুম শোকে ভেঙে পড়েছেন। এক অনাগত জীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে তিনি হারালেন তার প্রিয় মানুষটিকে।

তৌকির সর্বশেষ রাজশাহীতে গিয়েছিলেন চলতি বছরের কোরবানি ঈদে, জুন মাসে। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আবার ফিরে যান ঢাকায়। সেটিই ছিল তার শেষ দেখা, শেষ বিদায়।

সাহসিকতার প্রতীক ছিল সলো ফ্লাইট—তৌকির পেরিয়ে গিয়েছিলেন সব ধাপ

সলো ফ্লাইট পাইলট প্রশিক্ষণের এক গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল ধাপ। একা বিমান চালিয়ে সফলভাবে অবতরণ করতে পারলে তবেই একজন বৈমানিক ফাইটার জেট পরিচালনার জন্য প্রস্তুত বলে বিবেচিত হন। তৌকির সেই গুরুত্বপূর্ণ ধাপেই ছিলেন।

সফলভাবে উড্ডয়ন করেন তিনি, কিন্তু কিছু সময় পর রেডিও সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে জানা যায়, তার বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। মাটিতে ফিরে আসেননি তৌকির—চিরদিনের জন্য আকাশেই থেকে গেলেন।

বিমানবাহিনী ইতোমধ্যে ঘটনার তদন্তে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। যান্ত্রিক ত্রুটি, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ব্যর্থতা, নাকি অন্য কোনো কারণ—সবই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পরিবারে শোকের ছায়া—রাজশাহীতে স্তব্ধতা, কান্না আর আকাশপানে চাওয়া

রাজশাহীর সপুরা এলাকার ‘আশ্রয়’ ভবনের ফ্ল্যাটটি এখন নিঃস্তব্ধ। স্বজনদের চোখে কান্না, মুখে নিস্তব্ধতা। তৌকিরের মা বারবার শুধু একটি কথাই বলছেন—”ওতো কেবল শুরু করেছিল… ওর যে এভাবে চলে যেতে হবে, ভাবতেই পারিনি।”

পড়াশোনা, চাকরি, বিয়ে—সবই চলছিল গোছানোভাবে। স্বপ্ন ছিল দেশের আকাশে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালনের। সেই স্বপ্ন তছনছ হয়ে গেল এক ঝড়ের মতো।

তৌকিরদের জন্যই জাতি গর্ব করে

তৌকির ছিলেন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি। সাহস, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ আর দেশপ্রেমের প্রতীক। তার মতো মেধাবীরা হারিয়ে গেলে শুধুমাত্র পরিবার নয়—পুরো জাতিই হারায় এক সম্ভাবনা।

আমরা যেন তাকে ভুলে না যাই। আমরা যেন এই মৃত্যুকে শুধু এক দিনের শোক বানিয়ে না ফেলি। বরং এটি হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা—বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা, প্রযুক্তি এবং মানবিক দিকগুলো আরও উন্নত করতেই হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো তৌকির ইসলাম না হারিয়ে যায় আকাশেই।

📌 তথ্যবক্স: ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম

  • পূর্ণ নাম: তৌকির ইসলাম সাগর
  • গ্রাম: কানসাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
  • বর্তমান বাসা: সপুরা, রাজশাহী
  • স্কুল: রাজশাহী ল্যাবরেটরি স্কুল
  • ক্যাডেট কলেজ: পাবনা ক্যাডেট কলেজ
  • স্ত্রী: আকশা আহম্মেদ নিঝুম, শিক্ষিকা (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়)
  • শেষ ঈদ: ২০২৫ সালের জুন, রাজশাহীতে
  • দুর্ঘটনার দিন: সোমবার, জুলাই ২০২৫
  • উড্ডয়ন ধাপ: প্রথম একক (সলো) ফ্লাইট

শেষ বাক্য:
তৌকির ইসলাম এখন শুধু একজন পাইলট নন, হয়ে উঠেছেন সাহস, স্বপ্ন এবং স্বদেশপ্রেমের এক প্রতীক। তার উড্ডয়ন থেমে গেলেও, তার রেখে যাওয়া আকাশজয়ী ইচ্ছেগুলো যেন আমাদের মাটিতে গেঁথে যায়—দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনের এক অনন্ত প্রেরণার মতো।