চাহিদা বেড়েছে তিনগুণ, দুধ ও মাংসে স্বনির্ভরতার পথে দেশ
তারিক-উল-ইসলাম, ঢাকা: বাংলাদেশের পশুসম্পদ খাত গত এক দশকে বিস্তর উন্নতি দেখেছে। গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগি, সব খাতে উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। একই সঙ্গে জনগণের আয় বৃদ্ধি ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে প্রাণিজ পণ্যের চাহিদাও বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। তবে, পশুখাদ্য ও কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং খামার পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমছে খামারিদের।
সরকারি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ গবাদি পশু রয়েছে, যা এক দশক আগের তুলনায় প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। দুধ উৎপাদন বেড়েছে বছরে গড়ে ৭ শতাংশ হারে, এবং বর্তমানে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন দুধ উৎপাদন করে। ডিম উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জিত হলেও, দুধ ও মাংসে এখনো আমদানিনির্ভরতা পুরোপুরি কাটেনি।
দেশে মাংসের উৎপাদন ২০১৫ সালে ছিল প্রায় ৬৫ লাখ টন, যা ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯৫ লাখ টনে। কিন্তু একই সময়ে পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশের বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন, ভুট্টা ও ফিড অ্যাডিটিভের দাম বাড়ায় স্থানীয় উৎপাদকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
খামারিরা বলছেন, প্রতি কেজি ফিডের দাম এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে ছোট ও মাঝারি খামারগুলো টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেকে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন, কেউ কেউ খামার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।
মাংসের খুচরা মূল্যও দ্রুত বেড়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল প্রায় ৪৩০ টাকা, সেখানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৭০০ টাকার ওপরে পৌঁছেছে। একইভাবে দুধের দামও বেড়েছে ৩০-৩৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের পশুসম্পদ খাতের অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে স্থানীয় ফিডশস্য উৎপাদনে জোর দিতে হবে। পাশাপাশি পশুখাদ্য আমদানিতে কর-রেয়াত, খামারি প্রশিক্ষণ, ভ্যাকসিন ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
সরকারও এখন খাতটিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। নতুন বিনিয়োগনীতি ও ক্ষুদ্র খামারি পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিদের উৎপাদন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ মাংসে স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে অগ্রসর হবে।
তবে খাতটির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং স্থিতিশীল বাজার নিশ্চিত করা। ফিডের দাম নিয়ন্ত্রণে না এলে ছোট খামারিরা টিকে থাকতে পারবে না বলে আশঙ্কা করছে শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
গত এক দশকের পশুসম্পদ খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণবন্ত অংশে পরিণত হয়েছে। এই খাত থেকে বছরে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের অস্থিরতা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং দুর্বল সরবরাহ শৃঙ্খল এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। টেকসই নীতিনির্ধারণ ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে এই খাত বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও রপ্তানি সম্ভাবনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।










