Home First Lead জাফলংয়ে পাথর উত্তোলনে লাগাম নেই, পরিবেশ বিধ্বস্ত

জাফলংয়ে পাথর উত্তোলনে লাগাম নেই, পরিবেশ বিধ্বস্ত

সংগৃহীত ছবি

বিজনেসটুডে২৪ প্রতিনিধি, সিলেট: সিলেটের জাফলং সীমান্তবর্তী এলাকা, যা একসময় পর্যটকদের স্বপ্নের গন্তব্য হিসেবে পরিচিত ছিল, এখন পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ পরিবেশগত সংকটে। পিয়াইন ও ডাউকি নদীর পাড় ঘেঁষে ছড়িয়ে থাকা পাথর কোয়ারি ও অবৈধ উত্তোলনের কারণে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে প্রকৃতি, নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে, বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি।

 সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাথর উত্তোলন চলছে। প্রশাসনের কিছু অসাধু চক্র, স্থানীয় প্রভাবশালী ও পাথর শ্রমিক সংগঠনগুলোর মদদে এই অবৈধ ব্যবসা দিনে দিনে আরও বিস্তৃত হয়ে পড়েছে।

জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালু-পাথর উঠানোর সাইটে পরিবেশ অধিদপ্তরের আভিযানিক দল্। ছবি সংগৃহীত

সম্প্রতি সরকারের কড়া অবস্থান

সর্বশেষ শনিবার (১৪ জুন ২০২৫) জাফলং এলাকা পরিদর্শনে যান অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা—পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
তারা ঘোষণা দেন, জাফলং একটি ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ECA)’ হিসেবে সরকারের তালিকাভুক্ত, তাই এখানে আর কোনো পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া হবে না। উপরন্তু, এলাকায় বিদ্যমান অবৈধ ক্রাশার মেশিনগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

পরিদর্শনকালে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, “জাফলং ধ্বংস হয়ে গেছে। এখান থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে নদীভাঙন, পানি দূষণ, বন্যার আশঙ্কা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।” তিনি জানান, পাথর উত্তোলনের বৈধ কোনো কার্যক্রমও ভবিষ্যতে এখানে অনুমোদন পাবে না।

শ্রমিকদের ক্ষোভ ও সংঘাতের আশঙ্কা

সরকারের এ ঘোষণার পরপরই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে স্থানীয় শ্রমিক ও বাসিন্দারা। তারা উপদেষ্টাদের গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভ করে এবং ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেয়। শ্রমিকদের দাবি, পাথর উত্তোলনই তাদের একমাত্র জীবিকা। কোনো বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছাড়াই কোয়ারি বন্ধ ঘোষণা করা হলে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।

এক শ্রমিক বলেন, “আমাদের পরিবার চলে পাথর তুলেই। এখন যদি বন্ধ করে দেয়, তাহলে খাবো কী? সরকার শুধু পরিবেশ দেখে, কিন্তু শ্রমিক দেখে না।”

পরিবেশ ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র

পরিবেশ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, জাফলং ও আশপাশের এলাকাগুলোতে পাথর উত্তোলনের ফলে গত দুই বছরে নদীর গভীরতা ৫ থেকে ৭ ফুট বেড়েছে, নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৮টি গ্রামের প্রায় ৩ হাজার পরিবার। ডাউকি নদীর স্বচ্ছ নীল জল এখন ঘোলা ও কাদা-মিশ্রিত। জাফলংয়ের বনাঞ্চলেও পাথর উত্তোলনের যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে, যা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করছে।

পর্যটন উন্নয়নের পরিকল্পনা

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “আমরা পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে একটি ইকো-ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করছি। যেখানে পরিবেশ সংরক্ষণ করেই পর্যটকদের জন্য জাফলংকে আকর্ষণীয় করে তোলা হবে। পাথর উত্তোলনকারীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও থাকবে।”

প্রশাসনিক তৎপরতা

পরিদর্শনের সময় সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মোহাম্মদ রেজাউল নবী, জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ ও পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। প্রশাসন জানিয়েছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অবৈধ কোয়ারির বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হবে।

উপসংহার

জাফলংয়ে পরিবেশ রক্ষা বনাম জীবিকার এই দ্বন্দ্ব এখন বড় এক জাতীয় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার একদিকে পরিবেশ রক্ষায় কঠোর হলেও, অন্যদিকে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে শ্রমিক অসন্তোষ সামাজিক অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে।