স্মৃতিতে নিজামউদ্দিন আহমেদ
কামরুল ইসলাম: আমি তখন রাজধানী ঢাকায় দৈনিক সংবাদ-এর নবনিযুক্ত স্টাফ রিপোর্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা তখনও শেষ হয়নি, হাতে এসেছে পেশাগত জীবনের প্রথম নিয়োগপত্র—“স্টাফ রিপোর্টার/সাব-এডিটর” হিসেবে। তরুণ মনে তখন উত্তেজনা, স্বপ্ন আর দায়িত্ববোধের ছায়া।
কিন্তু স্বপ্নের বাস্তবায়ন সহজ ছিল না। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে রিপোর্টিং থেকে সরিয়ে ডেস্কে বসিয়ে দেওয়া হয়। নিউজ ডেস্কে কাজ করার অভিজ্ঞতা যেন এক ভিন্ন জগত। টেলিপ্রিন্টারে ধাপে ধাপে আসত আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোর ইংরেজি বার্তা। মফস্বল সংবাদদাতাদের পাঠানো খণ্ডিত খবর কিংবা টেলিগ্রামের বার্তাও আসত নিয়মিত। সবই অনুবাদ, সম্পাদনা করে পাঠাতে হতো বার্তা সম্পাদকের কাছে।
দিনশেষে শরীরে ক্লান্তি নয়, মনেই যেন জেঁকে বসত একধরনের অতৃপ্তি—এই কি তবে সাংবাদিকতা? খবর সংগ্রহের রোমাঞ্চ নয়, মানুষের জীবনের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ নেই; শুধুই অফিসঘরের একঘেয়ে ধরণ।
ঠিক এমন সময়ে এক দুপুরে আমাকে ডেকে পাঠালেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান। জানালেন, চট্টগ্রামে সংবাদ-এর প্রতিনিধি মোহাম্মদ বেলাল দীর্ঘদিন ধরে ছুটিতে, তাঁর স্থলে আপাতত আমাকেই পাঠানো হচ্ছে। তিনি বললেন, “তোমার তো বাড়ি ওই এলাকাতেই, তোমার জন্য সুবিধা হবে।”
ইচ্ছা আর অনিচ্ছার দোলাচলে আমি ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম পৌঁছালাম। সংবাদ-এর চট্টগ্রামে নেই কোনো অফিস, এমনকি নেই একটি নির্ভরযোগ্য টেলিফোন সংযোগও। সাংবাদিক হিসেবে যা দরকার—তার কিছুই সেখানে আমার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
চট্টগ্রাম শহরের অলিগলি তখন আমার কাছে প্রায় অচেনা। আমি মূলত গ্রামের ছেলে—বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হাটহাজারির জোবরা-ফতেহপুরে। চট্টগ্রাম শহরকে চিনেছি কেবল বাসে ওঠা-নামার ফাঁকে, শহরের স্বরূপ তখনো ধরা দেয়নি।
ভাবলাম, স্থানীয় সাংবাদিকেরা হয়তো সহায়তা করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো উল্টো। আমিই তখন বয়সে সবচেয়ে কনিষ্ঠ এবং পেশাগতভাবে নবীন। পরে জানতে পারি, মোহাম্মদ বেলাল মনে করতেন—আমি নাকি তাঁর জায়গা দখল করতে ঢাকায় চক্রান্ত করে চট্টগ্রামে এসেছি। তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলে রেখেছিলেন, যেন কেউ আমাকে সহয়োগিতা না করেন। তখন অবশ্য সাংবাদিকও ছিলেন একেবারে হাতে গোনা কয়েকজন।
এই পরিস্থিতিতে আমি ভেঙে পড়ি। মনে হয়েছিল, এক অচেনা শহরে আমি যেন একেবারে একা—অসহায়, ।
এমন এক একাকী সময়ে, নিছক পেশাগত দায়িত্ববোধ নয়, এক মানুষের নিঃস্বার্থ হৃদয় আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। সেই মানুষটির নাম নিজাম উদ্দিন আহমেদ। পরবর্তীতে নিজাম আহমেদ।
ঢাকায় কর্মরত বন্ধু মোস্তফা তারেক—যিনি নিউ নেশন-এ কাজ করতেন—তিনি পরিচয় করিয়ে দেন চট্টগ্রামের নিউ নেশন প্রতিনিধি নিজাম ভাইয়ের সঙ্গে।
জানি, তিনি মোহাম্মদ বেলালের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তবু পেছনের এসব গুঞ্জন বা বিভ্রান্তি তাঁকে একটুও প্রভাবিত করেনি। নিজাম ভাই প্রথম দিন থেকেই আমাকে গ্রহণ করেন এক সহকর্মীর চেয়েও বেশি কিছু হিসেবে।
তিনি আমাকে তাঁর হোন্ডায় তুলে বিভিন্ন রিপোর্টিং অ্যাসাইনমেন্টে নিয়ে গেছেন। অজানা শহরের অলিগলি চিনিয়েছেন, ফ্যাক্টস জোগাড়ে সহায়তা করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। তাঁর এই সহযোগিতা কেবল তথ্যগত নয়, ছিল আত্মিক।
পার্বত্য শান্তিচুক্তির আগে আমরা একাধিকবার খাগড়াছড়ি গিয়েছি সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শান্তিবাহিনীর সংলাপ কাভার করতে। পাহাড় তখন উত্তপ্ত, অজানা আশঙ্কা সবসময়ই আমাদের ঘিরে রাখত। কিন্তু নিজাম ভাইয়ের পাশে থাকলে ভরসা পেতাম।
আমার বাবার মৃত্যু সংবাদ আসে গ্রামের বাড়ি থেকে। সঙ্গে টাকাপয়সা নেই। বাসায় ফিরে টাকা নেব সে সময় নেই। এমন অসহায় মুহূর্তে নিজাম ভাই নিজেই তাঁর স্ত্রীকে ফোন করে বলেন, আমি যেন তাঁর বাসায় গিয়ে টাকা নেই। সে মুহূর্তে তিনি শুধু এক সহকর্মী ছিলেন না—ছিলেন আমার বড় ভাই, আমার আত্মীয়।
১৯৮৫ সালের আগস্টে আমি সংবাদ- ছেড়ে দৈনিক খবর-এ যোগদান করি। চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা। কয়েকবছর পর চাকরিহারা হয়ে চট্টগ্রাম চলে আসি। বেশ অর্থসংকটে পড়ে যাই। নিজামও ততদিনে নিউ নেশন ছেড়ে গেছেন। বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি ( বিএনএ ) নামে একটি বাংলা সংবাদ সংস্থা করেছেন। সেটাই দেশের প্রথম এ ধরনের সংস্থা। হাতে লেখা খবর ফ্যাক্সযোগে বিভিন্ন সংবাদপত্রের কাছে দেয়া হতো। তাতে তেমন আয় হতো না। কোনরকমে হয়তো খরচ ওঠতো। তিনি নিজে এবং আরেক তরুণ সাংবাদিক কামালউদ্দিন খোকনকে দিয়ে কাজ চলতো। নিজাম ভাই তখন রয়টার-এ ও কাজ করতেন।
এই খোকন ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন। যে কোন অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে নোট নিতো না। সব মাথায় ভর্তি করে নিয়ে আসতো আর অফিসে ফিরে গরগর করে লিখে ফেলতো কয়েকপৃষ্টা ধরে। নিজাম সাহেব আমাকে একদিন বললেন, বসে বসে সময় না কাটিয়ে এখানে এসে কিছু কাজ করুন। তবে, তেমন কিছু দিতে পারব না। বড়জোর যাওয়া-আসার খরচটা। কাজ করেছি বেশ কিছুদিন সেখানে। মাসশেষে কিছু টাকা দিতেন। একবার এক মাসে আমাকে কোনো অর্থ দিতে না পারায়, তিনি স্ত্রীর গহনা বন্ধক রেখে আমার জন্য টাকা জোগাড় করেন। এই নিঃস্বার্থ সহায়তার কথা স্মরণ করে আজও আমার গলা আটকে আসে।
পরবর্তীতে বিএনএ বন্ধ হয়ে যায়। নিজাম ভাই রয়টার-এর হয়ে ঢাকায় চলে যান। যোগাযোগ তখনো চলত। চট্টগ্রামের ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো খবর দরকার হলে আমাকে জানাতেন, আমি চেষ্টা করতাম সাহায্য করার। আমাদের পেশাগত সম্পর্ক ছাড়িয়ে তখনকার সম্পর্ক ছিল আত্মার।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের নির্বাচন, বনভোজন, সামাজিক আয়োজন—সবখানেই নিজাম ভাই ছিলেন প্রাণবন্ত, আন্তরিক। ব্যক্তিগত কষ্ট, আনন্দ—সবই ভাগ করে নিয়েছেন আমার সঙ্গে।
জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি দ্য ডেইলি অবজারভার-এর বিজনেস এডিটর হিসেবে কাজ করতেন। ২০২৫ সালের ২৯ জানুয়ারি ভোরে ঢাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি চলে যান।
আমার ছোট ভাই ম. শামসুল ইসলাম—চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সাধারণ সম্পাদক—যখন ফোন করে খবরটা দেয়, তখন আমার সব অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে যায়। কোথায়, কখন, কীভাবে—জিজ্ঞেস করার শক্তি পর্যন্ত ছিল না।
নিজাম ভাই, আপনি কেবল সাংবাদিক ছিলেন না, আপনি ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ—এক নির্ভরতার নাম। জীবনের প্রতিটি চূড়ান্ত বাঁকে, পেশার নৈরাশ্য আর মানবিক দুর্দিনে আপনি ছিলেন আমার সাহসের উৎস।
আমি দোয়া করি, মহান আল্লাহ যেন আপনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করেন। আমিন।