কামরুল ইসলাম:
আজকের ডিজিটাল যুগে যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া, টেক্সট মেসেজিং এবং ই-মেইল আমাদের দৈনন্দিন যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম সেখানে একসময় ছিল পেনফ্রেন্ডশিপের বিশেষ গুরুত্ব। বিশেষত সত্তরের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত, পেনফ্রেন্ডশিপ ছিল এক ধরনের মেলবন্ধন যা মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছিল। তবে এই যুগে পেনফ্রেন্ডশিপ আজ আর আগের মতো প্রতিস্থাপন হয়নি। চিঠির মাধ্যমে সম্পর্কের গভীরতা, বিশ্বাস এবং ভালোবাসার যে অনুভূতি ছিল, তা এখন দ্রুত যোগাযোগের কারণে অনেকটাই হারিয়ে গেছে।
পেনফ্রেন্ডশিপ বা চিঠির বন্ধুত্ব ছিল তখনকার সময়ের একটি জনপ্রিয় সামাজিক রীতি, যা বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্রে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো। বিশেষত সাপ্তাহিক বিচিত্রা বা অন্য কিছু জনপ্রিয় ম্যাগাজিনে “পত্র মিতালী” শিরোনামে পেনফ্রেন্ডশিপের জন্য আগ্রহী মানুষের নাম, বয়স, ঠিকানা, সখ এবং জীবনযাপন সম্পর্কে তথ্য ছাপা হতো। এই খণ্ডখণ্ড তথ্যের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে একটি সুস্থ বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারত।
তবে এখানে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটত যা অনেকেই তখন বুঝতে পারতেন না। মেয়েরা খুব সহজে বা তাড়াতাড়ি ছবি বিনিময় করতে চাইতো না। তাদের জন্য ছবির বিনিময় বা অতিরিক্ত ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা ছিল অস্বস্তির। কিন্তু ছেলেরা এই চিঠির মাধ্যমে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতো। প্রায়শই দেখা যেত, কিছু ছেলে মেয়েদের নাম দিয়ে পত্রমিতালীতে অংশগ্রহণ করতো, অর্থাৎ মেয়ে সেজে বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করতো। এই নিয়মটি সেই সময়কার সেকেলে সামাজিক পরিস্থিতি এবং নিষিদ্ধ সম্পর্কের প্রতি আকর্ষণের প্রতিফলন ছিল।
পত্রমিতালী কলামে মেয়েদের নাম-ঠিকানা একেবারে থাকতো না বলা চলে। কালে ভদ্রে দু’একজনের নাম ছাপা হলে আর কথা নেই। প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে চিঠি আসতো ছেলেদের। পোস্টম্যানের ঝুলি ভর্তি হয়ে যেতো।
চিঠির মাধ্যমে একে অপরকে জানার যাত্রা ছিল একেবারে নতুন। আসলেই সেই সময়ের সম্পর্কগুলো ছিল গভীর এবং আন্তরিক। একটি চিঠি অনেক কিছু বলে দিত। এটি ছিল এক উন্মুক্ত দরজা। সেখানেদুই অজানা মানুষ একে অপরকে চিঠির মাধ্যমে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারত।
এ প্রসঙ্গে আমার একটি কথা মনে পড়ে। পেন ফ্রেন্ডশিপ থেকে একটি সফল প্রেমের শেষে ব্যর্থতা এসেছিল অনুপম-শ্রাবন্তীর। অনুপম নামের এক তরুণ পেনফ্রেন্ডশিপ ম্যাগাজিনে নিজের নাম এবং ঠিকানা দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে তার পরিচয় হয় শ্রাবন্তী সরকারের সঙ্গে। শ্রাবন্তীর হাতের লেখার নৈপুণ্যে অনুপম মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের ভালোবাসা জানায়। তখনকার দিনে এটি ছিল এক সাহসী পদক্ষেপ, যেখানে একটি তরুণ তার অনুভূতি প্রকাশ করতে চিঠির মাধ্যমে একে অপরকে জানাতে পারত। এই ধরনের সম্পর্কগুলো পরে প্রেমে পরিণত হয়ে, অনেক ক্ষেত্রেই বিয়ের দিকে এগিয়ে যেত। তবে, অনুপম-শ্রাবন্তীর সেই প্রেম শেষ পর্যন্ত অবশ্য ব্যর্থ হয়েছিল।
আজকের দিনে পেনফ্রেন্ডশিপে যে ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে সেই সময়ের চিঠি, যেখানে একে অপরকে ভালোবাসার কথা বলার সাহস ছিল, তা আজ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ডিজিটাল যোগাযোগের যুগে, যোগাযোগের গতি দ্রুত হলেও, চিঠির মাধ্যমে যে গভীরতা ও আন্তরিকতা তৈরি হত, তা এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। ইন্টারনেটের দ্রুত যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পর্কের ভাবনাগুলো এখন একেবারেই ভিন্ন। তবে সেই সময়ের পেনফ্রেন্ডশিপের স্মৃতি আজও আমাদের হৃদয়ে জীবিত রয়েছে এবং তা চিরকাল থাকবে।
শেষ কথা: পেনফ্রেন্ডশিপের যুগটি ছিল এক অমূল্য সময় যেখানে সোনালী চিঠিগুলো ছিল বন্ধুত্ব এবং প্রেমের অক্ষর। চিঠির মাধ্যমে একে অপরের মধ্যে তৈরি হতো বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং আন্তরিকতা। ডিজিটাল যুগের যোগাযোগের মাধ্যমে আজ আর সম্ভব হয় না। তবে সেই সময়ের পেনফ্রেন্ডশিপের স্মৃতি আজও অনেকের হৃদয়ে জীবিত রয়েছে এবং তা এক বিশেষ ধরণের সম্পর্কের নিদর্শন হিসেবে চিরকাল থাকবে।